মাইক্রোসফটের ব্যর্থ ১০টি পণ্য যা ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে

ইতিহাসের অন্যতম সফল প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে মাইক্রোসফট। তাদের উইন্ডোজ, এক্সবক্স থেকে শুরু করে অসংখ্য জনপ্রিয় প্রোডাক্ট আছে বাজারে যা পুরোপুরি সফল। আর এসব সফল পণ্যই মাইক্রোসফটকে গড়ে তুলেছে অন্যতম বড় টেক জায়ান্ট হিসেবে। 

মাইক্রোসফটের এই সফলতার যুগ শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকেই। পিসি ব্যবহারকারীদের কাছে মাইক্রোসফট এক নামে পরিচিত। শুধুমাত্র তাদের উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমই বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রায় এক বিলিয়ন মানুষ ব্যবহার করছে। এছাড়াও গেমিংয়ের ক্ষেত্রে এক্সবক্স বাজারে এনে মাইক্রোসফট একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। তাছাড়া মাইক্রোসফটের অফিস সফটওয়্যার সবথেকে বেশি ব্যবহৃত একটি প্রোডাক্টিভিটি অ্যাপ্লিকেশন। এমনকি তাদের তৈরি ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার ব্রাউজারও একটা সময় ৯০ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ব্যবহার করতো!

টেকনোলজির উপর এবং আমাদের জীবনের উপর মাইক্রোসফটের প্রভাব অনস্বীকার্য। তবে এতো সব সফলতার মাঝেও মাইক্রোসফট টেক দুনিয়ার সবথেকে বড় কিছু ব্যর্থ প্রোডাক্টও এনেছে বাজারে। আজকের এই পোস্টে আমরা মাইক্রোসফটের এই ব্যর্থ প্রোডাক্টগুলো নিয়েই জানবো।

মাইক্রোসফট ব্যান্ড

ফিটনেস ব্যান্ডের বাজার যখন ২০১৪ সালে সবেমাত্র বড় হতে শুরু করেছে মাইক্রোসফট তখনই তাদের ফিটনেস ব্যান্ড বাজারে নিয়ে আসে। প্রথম এডিশনের ব্যান্ডটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় হলেও তাতে বেশ কিছু সমস্যা ছিল। যেমনঃ এই ব্যান্ড পরে অনেক ব্যবহারকারীই বিরক্তি বোধ করেছিলেন। এছাড়াও ব্যান্ডটি খুব বেশি মজবুত ছিলো না। ফলে সহজেই তা ভেঙ্গে বা নষ্ট হয়ে যেত। 

২০১৫ সালে তাদের ব্যান্ডের দ্বিতীয় ভার্সনটি বাজারে আনলেও পুরনো সমস্যাগুলো পুরোপুরি সমাধান করতে পারেনি মাইক্রোসফট। বরং এসব সমস্যা ঠিক করতে গিয়ে মাইক্রোসফট অনেক প্রয়োজনীয় ফিচার অ্যাড করেনি। যেমনঃ ব্যাটারি ব্যাকাপ ছিল ২ দিনেরও কম এবং ওয়াটারপ্রুফিং ছিল না। এছাড়া তাদের ব্যান্ডের মূল্যও ছিল বেশি। যদিও ফিটনেস ট্র্যাকিং ও অন্যান্য বিভিন্ন ভালো ফিচার এই ব্যান্ডে ছিল তবুও এসব কারণে ক্রেতারা দ্রুতই মুখ ফিরিয়ে নেয় এই ব্যান্ড থেকে। মাইক্রোসফট ২০১৬ সালে এটি বন্ধ ঘোষণা করে।

বব

পুরনো কম্পিউটার ব্যবহারকারী হয়ে থাকলে মাইক্রোসফটের ক্লিপির কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। নতুন পিসি ব্যবহারকারীদের নির্দেশনা দেয়ার মাধ্যমে কম্পিউটার ব্যবহার সহজ করতেই ক্লিপির জন্ম। তবে ক্লিপির আগেও মাইক্রোসফট এই কাজের জন্য ১৯৯৫ সালে ‘মাইক্রোসফট বব’ নামের অ্যাসিস্ট্যান্ট ব্যবহার করেছিল। এর মাধ্যমে নতুন কম্পিউটার ব্যবহারকারীরা সহজেই উইন্ডোজ ইন্টারফেসের সাথে পরিচিত হতে পারবেন বলেই আশা করেছিল মাইক্রোসফট।

তবে মাইক্রোসফটের এই অ্যাসিস্ট্যান্টের ব্যবহার ছিল বেশ জটিল। এমন এক সময়ে মাইক্রোসফট এই অ্যাসিস্ট্যান্ট বাজারে এনেছিল যখনও মানুষ ঠিকভাবে কম্পিউটারের সাথে পরিচিত হয়নি। ফলে সাধারণ ব্যবহারকারীদের জন্য এই অ্যাসিস্ট্যান্ট তেমন কোন কাজেই আসেনি। বরং এটির ব্যাপারে অনেক রকম সমালোচনা শুনতে হয় মাইক্রোসফটকে। মাইক্রোসফট বব মাত্র এক বছর টিকতে পেরেছিল। এরপরই মাইক্রোসফটকে তাদের এই অ্যাসিস্ট্যান্ট বন্ধ করে দিতে হয়। এরপরই মাইক্রোসফট ক্লিপি যার আসল নাম ছিল ‘ক্লিপিট’ সেটি বাজারে আনে মাইক্রোসফট।

মাইক্রোসফট ব্যান্ড

🔥🔥 গুগল নিউজে বাংলাটেক সাইট ফলো করতে এখানে ক্লিক করুন তারপর ফলো করুন 🔥🔥

উইন্ডোজ মি

‘উইন্ডোজ মি’ -কে বলা যায় মাইক্রোসফটের সবথেকে ব্যর্থ উইন্ডোজ ভার্সন। ২০০০ সালে উইন্ডোজ ৯৮ এর তৃতীয় আপডেট হিসেবে বাজারে আসে উইন্ডোজ মি বা উইন্ডোজ মিলেনিয়াম এডিশন। এটি মূলত যখন মাইক্রোসফট উইন্ডোজ এক্সপি ডিজাইন করছিল সে সময় তাদের আধুনিক সকল সেবার সাথে মানুষকে পরিচয় করিয়ে দিতে উইন্ডোজ ৯৮ এর আধুনিক ভার্সন হিসেবে বাজারে ছেড়েছিল মাইক্রোসফট।

উইন্ডোজের পুরনো ৯এক্স প্লাটফর্মে ডিজাইন করায় এই ভার্সনটির রিলাইবিলিটি নিয়ে খুব দ্রুতই সমালোচনার শুরু হয়। ফলে আধুনিক সুযোগ সুবিধা নিয়েও উইন্ডোজের এই ভার্সনটি ব্যর্থ হয় ব্যবহারকারীদের মন জয় করতে। মূলত এক বছর পরেই আরও ভালো একটি ভার্সন মাইক্রোসফট বাজারে আনবে এটি জেনেই মানুষ এই ভার্সনের প্রতি তেমন আগ্রহ দেখায় নি। তবে এই ভার্সনটি অনেক ক্ষেত্রেই যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল।

জুন

মাইক্রোসফটের জুন ছিল গান শোনার জন্য অ্যাপলের আইপডের প্রতিদ্বন্ধী। তবে আইপডের সমস্যাগুলোকে দূর করতে পারেনি মাইক্রোসফট। যদিও জুনের আলাদা বিভিন্ন ফিচার ছিল, তবুও অ্যাপলের পরে এরকম মিউজিক প্লেয়ার বাজারে আনায় মার্কেটিংয়ে বেশ পিছিয়ে ছিল মাইক্রোসফট। জুন প্রথমবারের মতো মিউজিক প্লেয়ারে ওয়াইফাই সংযুক্ত করে মানুষকে গান শেয়ার করার সুযোগ করে দিয়েছিল।

microsoft zune music player

শুধু তাই নয় বিভিন্ন সাবস্ক্রিপশন সার্ভিসের মাধ্যমে গান শোনার ব্যবস্থাও প্রথম এনেছিল মাইক্রোসফটের এই মিউজিক প্লেয়ার। তবে শেষ পর্যন্ত অ্যাপলের আইপডের সঙ্গে প্রতিযোগীতায় পেরে ওঠেনি মাইক্রোসফট। ২০১২ সালে মাইক্রোসফট তাদের এই ডিভাইস তৈরি বন্ধ করে দেয়।

গ্রুভ মিউজিক

মাইক্রোসফট মিউজিক স্ট্রিমিংয়ের দুনিয়ায় জায়গা করে নিতে তাদের গ্রুভ মিউজিক প্ল্যাটফরম চালু করে উইন্ডোজ ১০ এর সঙ্গে। তবে এখানেও প্রতিযোগীতায় তারা স্পটিফাইয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পেরে ওঠেনি। মূলত এই বাজারে মাইক্রোসফটের দেরি করে প্রবেশ করার চেষ্টাই দায়ী। এছাড়াও গান সিলেকশনেও বেশ পিছিয়ে ছিল তারা। ফলে দ্রুতই গ্রুভ মিউজিক বন্ধ করে দেয় মাইক্রোসফট এবং গ্রুভ মিউজিকের সবকিছু স্পটিফাইয়ে রিডাইরেক্ট করা শুরু করে।

👉 উইন্ডোজ ১১ এর লুকানো থিম চালু করার উপায়

মাইক্রোসফট কিন

মাইক্রোসফট কিন একটি মোবাইল ফোন যা মূলত মাইক্রোসফট বাজারে এনেছিল বিশেষভাবে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করার জন্য। এতে স্লাইডিং কোয়ারটি কীবোর্ড ব্যবহার করেছিল মাইক্রোসফট। তবে বাজারে এই ফোনটি টিকে ছিল মাত্র ২ মাস। এরপরই সকল প্রোডাক্ট মাইক্রোসফটের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়। এই ফোনে থার্ড পার্টি অ্যাপ ইন্সটল করার কোন উপায় ছিল না। তাছাড়া ছোট স্ক্রিন, ডিজাইন, ওএস সবকিছুই ক্রেতাদের নজর কাড়তে সক্ষম হয়ে ওঠেনি।

উইন্ডোজ ফোন ও লুমিয়া

আইওএস ও অ্যান্ড্রয়েডের বিপক্ষে প্রতিযোগিতায় নামতে মাইক্রোসফট তাদের উইন্ডোজ ফোন ওএস ডিজাইন করে যা ছিল বেশ দ্রুত গতির। ২০১০ সালে মাইক্রোসফট তাদের এই ওএস দিয়ে বাজারে ছাড়ে উইন্ডোজ মোবাইল। বাজারের সেরা কিছু হার্ডওয়্যার দিয়েই এসব ফোন বাজারে এসেছিলো। তবে এই ফোন কেন ব্যর্থ হল?

microsoft lumia smartphone

মূল কারণ ছিল একটাই; অ্যাপ সল্পতা। মাইক্রোসফট অ্যাপ ডেভেলপারদের তাদের ফোনের জন্য অ্যাপ তৈরি করতে আগ্রহী করে তুলতে ব্যর্থ হয়। ফলে অনেক জনপ্রিয় অ্যাপ উইন্ডোজ ফোন ব্যবহারকারীরা ব্যবহার করতে পারতো না। ফলে অসাধারন সব হার্ডওয়্যার ও ফিচার থাকা সত্ত্বেও ধীরে ধীরে উইন্ডোজ ফোনের ব্যবহারকারী কমে যেতে থাকে। নকিয়া কোম্পানিকে কিনে নেয়ার মাধ্যমে লুমিয়া নামে তাদের ফোন বাজারজাত করে শেষ চেষ্টা করেছিল মাইক্রোসফট। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে এই ফোন তৈরি বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দেয় মাইক্রোসফট।

👉 উইন্ডোজ ১০ এর জন্য জরুরি সতর্কতা বার্তা মাইক্রোসফটের

উইন্ডোজ ভিস্তা

উইন্ডোজ এক্সপি এর পর মাইক্রোসফট নতুন জেনারেশনের উইন্ডোজ হিসেবে উইন্ডোজ ভিস্তা নিয়ে আসে বাজারে ২০০৭ সালে। উইন্ডোজ ভিস্তা অনেক দিক থেকেই ছিল নতুন যুগের উইন্ডোজের সূচনা। তবে কিছু কারণে ভিস্তা ব্যবহারকারীদের কাছে তেমন সফলতা পায় নি।

একদম নতুন ভাবে ডিজাইন করায় এবং নতুন ড্রাইভারের প্রয়োজন হওয়ায় এই অপারেটিং সিস্টেম প্রথমদিকে উইন্ডোজ ৯৫ এর থেকেও ধীরগতির ছিল। ফলে অনেক ব্যবহারকারীই প্রিয় উইন্ডোজ এক্সপি ছেড়ে এই নতুন অপারেটিং সিস্টেমে পরিবর্তন করতে আগ্রহ দেখায় নি। তবে আধুনিক উইন্ডোজের বেশিরভাগ ফিচারই প্রথম সামনে এনেছিল উইন্ডোজ ভিস্তা।

উইন্ডোজ ৮ ও উইন্ডোজ আরটি

উইন্ডোজ ৮ বের হয়েছিলো মাইক্রোসফটের অন্যতম জনপ্রিয় উইন্ডোজ ভার্সন উইন্ডোজ ৭ এর মাত্র ৩ বছর পরেই। কিন্তু উইন্ডোজ এই ভার্সনে হঠাৎ করে অনেক পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল যা ব্যবহারকারীরা পছন্দ করেনি। মূলত এই অপারেটিং সিস্টেম মাইক্রোসফট ডিজাইন করেছিল টাচ ডিভাইসের জন্য। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই ডেস্কটপ এর সাথে মানানসই ছিল না।

windows 8 OS

মাইক্রোসফট তাদের ব্যবহারকারীদের প্রিয় স্টার্ট বাটন সরিয়ে দিয়েছিল। সব মিলিয়ে ব্যবহারকারীরা উইন্ডোজ ৮ পছন্দ করতে পারেনি। উইন্ডোজ আরটি ছিল ট্যাবলেটের জন্য তৈরি মাইক্রোসফটের বিশেষ অপারেটিং সিস্টেম যা উইন্ডোজ ৮ এর মতোই ব্যর্থ হয়েছিলো।

কর্টানা

কর্টানা নতুন প্রজন্মের ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে বাজারে এনেছিল মাইক্রোসফট। তবে অনেক প্রোডাক্টের মতোই মাইক্রোসফট এখানেও বেশ দেরি করে ফেলেছিল। ততদিনে বাজার গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট, এলেক্সা, সিরির মতো অ্যাসিস্ট্যান্ট পুরোপুরি দখল করে নিয়েছিল। ফলে এটিও খুব কম মানুষের কাছেই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। যদিও মাইক্রোসফট অ্যাসিস্ট্যান্ট এখনও বাজারে আছে, তবে এটি মাইক্রোসফট যে আশা নিয়ে তৈরি করেছিল তা পূরণ হয় নি।

👉 উইন্ডোজ বিটলকার কি? এর সুবিধা ও ব্যবহারের নিয়ম জানুন

📌 পোস্টটি শেয়ার করুন! 🔥

সর্বশেষ প্রযুক্তি বিষয়ক তথ্য সরাসরি আপনার ইমেইলে পেতে ফ্রি সাবস্ক্রাইব করুন!

Join 8,543 other subscribers

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *