অবৈধ মোবাইল বন্ধে আসছে নতুন সিস্টেম: কার্যকর শীঘ্রই

বাংলাদেশে অবৈধ মোবাইল হ্যান্ডসেট ব্যবহারের যুগ শেষ হতে চলেছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ঘোষণা দিয়েছে যে আগামী ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫ থেকে দেশে চালু হবে ন্যাশনাল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্টার বা NEIR। এই প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থার মাধ্যমে শুধুমাত্র অনুমোদিত, বৈধ ও মানসম্মত মোবাইল ফোনই দেশের মোবাইল নেটওয়ার্কে যুক্ত হতে পারবে। অবৈধ, ক্লোন বা নকল IMEI সম্বলিত ফোন স্বয়ংক্রিয়ভাবে নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, ফলে গ্রাহক নিরাপত্তা ও সেবার মান উভয়ই উন্নত হবে।

কেন এখন NEIR প্রয়োজন

দেশে প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক মোবাইল ফোন ব্যবহৃত হয় এবং এর একটি অংশ অবৈধভাবে আমদানি বা নকল IMEI দিয়ে বাজারে আসে। এসব ডিভাইস প্রায়ই আর্থিক জালিয়াতি, সাইবার অপরাধ, ফিশিং কল, ভুয়া রেজিস্ট্রেশন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়িয়ে অপরাধ সংঘটনে ব্যবহৃত হয়। ২০২৪ সালের একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশের ডিজিটাল জালিয়াতির বড় অংশই অবৈধ ডিভাইস বা সিম থেকে পরিচালিত হয়; বিটিআরসি বলছে, কেবল অবৈধ হ্যান্ডসেটের কারণেই প্রতিবছর কয়েক শত কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হয়। তাই NEIR কেবল প্রযুক্তিগত আপডেট নয়, এটি অর্থনীতি ও জননিরাপত্তার জন্য কাঠামোগত উদ্যোগ।

NEIR কীভাবে কাজ করবে

NEIR মূলত একটি জাতীয় ডাটাবেস, যেখানে দেশের সব বৈধ মোবাইল হ্যান্ডসেটের IMEI নম্বর সংরক্ষিত থাকবে। IMEI হলো প্রতিটি ফোনের জন্য নির্দিষ্ট ইউনিক আইডেন্টিটি। নতুন কোনো হ্যান্ডসেট প্রথমবার নেটওয়ার্কে সংযুক্ত হলে তার IMEI স্বয়ংক্রিয়ভাবে NEIR ডাটাবেসে মিলিয়ে দেখা হবে। ফোনটি বৈধ হলে সেটি সঙ্গে সঙ্গে নিবন্ধিত হয়ে সক্রিয় থাকবে। আর যদি নম্বরটি ক্লোন বা অবৈধ হয়, ব্যবহারকারীকে এসএমএসে জানানো হবে এবং এক মাসের গ্রেস পিরিয়ড শেষে ডিভাইসটি নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।

আপনার ফোন বৈধ কি না, সহজ যাচাই পদ্ধতি

১৬ ডিসেম্বর ২০২৫ থেকে যেকোনো ফোন কেনার আগে ক্রেতা সহজে বৈধতা যাচাই করতে পারবেন। মোবাইলের মেসেজ অপশনে গিয়ে “KYD”, একটি ফাঁকা স্পেস এবং ১৫ ডিজিটের IMEI লিখে ১৬০০২ নম্বরে পাঠাতে হবে। ফিরতি মেসেজে জানিয়ে দেওয়া হবে ফোনটি বৈধ নাকি অবৈধ। বর্তমানে ব্যবহৃত পুরোনো হ্যান্ডসেটগুলো আলাদা করে নিবন্ধনের দরকার নেই; এগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে NEIR-এ অন্তর্ভুক্ত হবে। তবু চাইলে *16161# ডায়াল করে হালনাগাদ অবস্থা দেখা যাবে।

বিদেশ থেকে আনা বা উপহারপ্রাপ্ত ফোনের বিশেষ নিবন্ধন

যারা বিদেশ থেকে বৈধভাবে ফোন কিনে আনেন বা উপহার পান, তাদের ডিভাইস ৩০ দিনের জন্য প্রাথমিকভাবে নেটওয়ার্কে সচল থাকবে। এই সময়ের মধ্যে অনলাইন পোর্টাল neir.btrc.gov.bd সাইটে ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট তৈরি করে পাসপোর্ট, ইমিগ্রেশন সিল, ক্রয় রশিদ এবং প্রযোজ্য হলে কাস্টমস শুল্ক পরিশোধের প্রমাণপত্র আপলোড করে বিশেষ নিবন্ধন সম্পন্ন করতে হবে। যাচাই শেষ হলে বৈধ ডিভাইস স্থায়ীভাবে নেটওয়ার্কে থাকেবে। ইন্টারনেট সুবিধা না থাকলে অপারেটরের কাস্টমার কেয়ার সেন্টারের সহায়তায় একই সেবা নেওয়া যাবে।

person holding smartphone iphone

🔥🔥 গুগল নিউজে বাংলাটেক সাইট ফলো করতে এখানে ক্লিক করুন তারপর ফলো করুন 🔥🔥

হারানো বা চুরি হওয়া ফোন লক/আনলক

NEIR চালু হলে কোনো ফোন হারিয়ে গেলে বা চুরি হলে সেটি লক করার আবেদন দেওয়া যাবে সিটিজেন পোর্টাল, মোবাইল অ্যাপ বা অপারেটরের কাস্টমার কেয়ারের মাধ্যমে। প্রয়োজনে মালিকানা নিশ্চিত করে আবার আনলকও করা যাবে। এতে ব্যবহৃত ডিভাইস দ্রুত নিষ্ক্রিয় করা সম্ভব হওয়ায় মোবাইল চুরি সংক্রান্ত অপরাধ কমার সম্ভাবনা তৈরি হবে।

খুচরা ক্রেতার কী লাভ

সবার আগে আসে নিশ্চয়তা। নতুন ফোন কেনার আগে বৈধতা যাচাই করা যাবে বলে প্রতারণার সুযোগ কমে যাবে। অপারেটর নেটওয়ার্কে অবৈধ ডিভাইস ধরা পড়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, ফলে কল ড্রপ, নেটওয়ার্ক অস্থিরতা কিংবা অদৃশ্য সিকিউরিটি রিস্কের ঝুঁকিও কমবে। গ্রাহক নিজের মালিকানাধীন ডিভাইস ডি–রেজিস্ট্রেশন করে আইনসম্মতভাবে অন্যের কাছে হস্তান্তর করতে পারবেন; কর্পোরেট সিম ব্যবহারকারীরাও নির্ধারিত প্রক্রিয়ায় তথ্য আপডেট করে ডি–রেজিস্ট্রেশন সুবিধা পাবেন।

বিক্রেতা, আমদানিকারক ও উৎপাদনকারীদের দায়িত্ব

বাজারজাত করার আগে প্রতিটি মডেলের IMEI বিটিআরসিতে জমা দিতে হবে এবং ডেলিভারির সময় IMEI যাচাই বাধ্যতামূলক। নকল বা ডাটাবেসে নেই—এমন IMEI যুক্ত ফোন বিক্রি করলে সেটি নেটওয়ার্কে চলবে না এবং সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে নীতিমালা মেনে স্থানীয়ভাবে তৈরি হ্যান্ডসেটের IMEI আগে থেকেই কমিশনে দাখিল করতে হবে। এতে বাজারে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পাবে এবং মূল্য–মানের ভারসাম্য রক্ষা করা সহজ হবে।

দেশীয় মোবাইল শিল্পে সম্ভাব্য প্রভাব

NEIR কার্যকর হলে চোরাই ও রিফার্বিশড ডিভাইসের প্রবেশ কমবে। এতে দেশীয় ১৮টির মতো প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতামূলক দামে নির্ভরযোগ্য ডিভাইস আনতে উৎসাহিত হবে। অবৈধ ডিভাইস বাজারে থাকলে বৈধ ব্র্যান্ডের ওপর চাপ পড়ে এবং মূল্য-মানের ভারসাম্য নষ্ট হয়; নতুন ব্যবস্থায় সেই চাপ কমবে। দীর্ঘমেয়াদে স্থানীয় কারখানায় বিনিয়োগ বাড়তে পারে এবং ভবিষ্যতে রপ্তানি সুযোগও তৈরি হতে পারে।

👉 বিটিসিএল আনবে নতুন মোবাইল সিম, থাকছে যেসব সুবিধা

নেটওয়ার্ক মান ও আর্থিক সেবায় নিরাপত্তা

অবৈধ বা নিম্নমানের ডিভাইস নেটওয়ার্কে থাকলে বেজ স্টেশন লেভেলে সিগন্যাল গুণমান প্রভাবিত হয়, কল সেটআপ টাইম বেড়ে যায় এবং ডিভাইস–সাইড ভ্যালনারেবিলিটিজ থেকে জালিয়াতির ঝুঁকি তৈরি হয়। NEIR এই খুঁতগুলো নিয়ন্ত্রণে আনবে বলে অপারেটর–লেভেলে ট্র্যাফিক কোয়ালিটি উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসে ব্যবহৃত ডিভাইস যখন বৈধতার আওতায় থাকবে, তখন একাউন্ট টেকওভার, সিম–সোয়াপ বা ফ্রড কলের শিকড় চিহ্নিত করাও সহজ হবে।

সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ ও সমাধান

প্রথম দিকে গ্রাহক সচেতনতা, বিদেশফেরত যাত্রীর দলিল যাচাই, কর্পোরেট সিমের তথ্য আপডেট ও পুরোনো ডেটাবেস ক্লিনআপ—এই চারটি ক্ষেত্রে চাপ বাড়তে পারে। সমাধান হিসেবে অপারেটর–দোকান, ই–কমার্স ও কাস্টমার কেয়ার পয়েন্টে এক–পৃষ্ঠার গাইড রাখা, এসএমএস–পুশ ও ইউএসএসডি মেনুতে ধাপে ধাপে নির্দেশনা দেওয়া, এবং মিডিয়ায় ধারাবাহিক ক্যাম্পেইন চালানো দরকার। ক্রেতা–বিক্রেতা উভয়ের জন্য স্ট্যান্ডার্ড ইনভয়েস টেমপ্লেট বাধ্যতামূলক করলে ক্রয়–প্রমাণ সংরক্ষণ সহজ হবে।

আন্তর্জাতিক প্র্যাকটিস ও বাংলাদেশের অবস্থান

ভারতের CEIR, পাকিস্তানের DIRBS বা নেপালের IMEI ভেরিফিকেশন, এই প্ল্যাটফর্মগুলো ইতিমধ্যে অবৈধ ডিভাইস নিয়ন্ত্রণে সাফল্য দেখিয়েছে। বাংলাদেশও একই রোডম্যাপ অনুসরণ করছে, তবে দেশের ব্যবহারকারীর প্রোফাইল, ফিচার ফোনের বড় অংশ এবং এমএফএস ইকোসিস্টেম বিবেচনায় রেখে স্থানীয় বাস্তবতায় কিছু অভিযোজন করা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে ইউএসএসডি চ্যানেলের মাধ্যমে অবস্থা জানার সুবিধা এবং ইন্টারনেট ছাড়াই কাস্টমার কেয়ারে নিবন্ধন সহায়তা, এগুলো ব্যবহারকারীবান্ধবতা বাড়াবে।

👉 মোবাইল দিয়ে টাকা আয় করে কীভাবে?

কীভাবে ডি–রেজিস্ট্রেশন করবেন

ব্যবহৃত ফোন বিক্রি বা অন্যকে হস্তান্তর করার আগে ডি–রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। এটি করা যাবে সিটিজেন পোর্টাল, অপারেটর পোর্টাল, মোবাইল অ্যাপ বা *16161# ইউএসএসডি চ্যানেলের মাধ্যমে। নিরাপত্তার জন্য গ্রাহকের এনআইডির শেষ চারটি ডিজিট দিতে হবে। যেসব ডিভাইসের IMEI ক্লোন বা ডুপ্লিকেট, তাদের ক্ষেত্রে নতুন ব্যবহারকারীর সিম নম্বর অতিরিক্ত তথ্য হিসেবে দিতে হতে পারে।

গ্রাহকের জন্য দ্রুত রিমাইন্ডার

ফোন কেনার আগে IMEI মিলিয়ে নিন, এসএমএস পাঠিয়ে বৈধতা নিশ্চিত করুন, ইনভয়েস অবশ্যই সংরক্ষণ করুন এবং বিদেশ থেকে ডিভাইস আনলে ৩০ দিনের মধ্যে অনলাইনে নিবন্ধন শেষ করুন। প্রয়োজনে ১০০ বা ১২১ নম্বরে কল করে সহায়তা নিন। সচেতন থাকলে পুরো প্রক্রিয়া দ্রুত, সহজ ও ঝামেলামুক্ত হবে।

শেষ কথা

NEIR চালু হওয়া বাংলাদেশের টেলিকম খাতে একটি কাঠামোগত পরিবর্তন আনবে। অবৈধ ডিভাইসের প্রবেশ কমে গেলে রাজস্ব বাড়বে, নেটওয়ার্ক পরিষেবা উন্নত হবে এবং গ্রাহকের তথ্য–নিরাপত্তা মজবুত হবে। নতুন ব্যবস্থাটি যত বেশি সচেতনতার সঙ্গে বাস্তবায়িত হবে, তত দ্রুত আমরা একটি স্বচ্ছ ও নিরাপদ মোবাইল ইকোসিস্টেমের দিকে এগিয়ে যাব।

📌 পোস্টটি শেয়ার করুন! 🔥

সর্বশেষ প্রযুক্তি বিষয়ক তথ্য সরাসরি আপনার ইমেইলে পেতে ফ্রি সাবস্ক্রাইব করুন!

Join 8,382 other subscribers

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *