বাংলাদেশে অ্যাপল পে ব্যবহার করার কৌশল

বাংলাদেশে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। শুধু ফোন কল বা সোশ্যাল মিডিয়া নয়, এখন মানুষ স্মার্টফোনকে ডিজিটাল লাইফস্টাইলের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করছে। অনলাইন শপিং, বিল পরিশোধ, কিংবা খাবার অর্ডার, সবকিছুতেই মোবাইল পেমেন্ট সিস্টেম জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

দেশে আইফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যাও বেড়েই চলছে। আইফোনের একটি অসাধারণ ফিচার হচ্ছে অ্যাপল পে, যা অ্যাপল ওয়ালেট অ্যাপের মাধ্যমে কাজ করে। এটা দিয়ে সহজে এবং নিরাপদে কেনাকাটার মূল্য পরিশোধ করা যায়। তবে প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশে অ্যাপল পে (Apple Pay) ব্যবহার করা যায় কি? আর যদি যায়, তাহলে সেটি ব্যবহারের সঠিক কৌশল কী?

অ্যাপল পে মূলত একটি ডিজিটাল ওয়ালেট ও মোবাইল পেমেন্ট সেবা, যা আইফোন, অ্যাপল ওয়াচ, আইপ্যাড বা ম্যাক দিয়ে নিরাপদে পেমেন্ট করতে সাহায্য করে। এটি বিশ্বব্যাপী অনেক দেশে চালু থাকলেও বাংলাদেশে সরাসরি অফিসিয়ালি এখনো পাওয়া যায়নি। তবুও কিছু কৌশল ব্যবহার করে বাংলাদেশি ব্যবহারকারীরা অ্যাপল পে-এর সুবিধা উপভোগ করতে পারেন। আজকের পোস্টে জানব সে সম্পর্কে বিস্তারিত।

অ্যাপল পে কীভাবে কাজ করে?

অ্যাপল পে মূলত কন্টাক্টলেস পেমেন্ট প্রযুক্তির উপর ভিত্তি করে তৈরি। আইফোন বা অ্যাপল ওয়াচে যখন আপনি আপনার ব্যাংক কার্ড যোগ করেন, সেটি সুরক্ষিতভাবে ডিভাইসে সংরক্ষিত থাকে। এরপর দোকান বা অনলাইন শপে পেমেন্ট করার সময় কেবল আপনার ডিভাইসটি POS মেশিনে স্পর্শ করতে হয় অথবা অনলাইন সাইটে অ্যাপল পে সিলেক্ট করতে হয়।

অ্যাপল পে-তে ব্যবহৃত হয় এনএফসি (NFC) টেকনোলজি এবং টোকেনাইজেশন সিস্টেম। অর্থাৎ, আপনার আসল কার্ড নাম্বার বা তথ্য কখনোই বিক্রেতার হাতে যায় না। বরং একটি ইউনিক টোকেন জেনারেট হয়। ফলে নিরাপত্তা অনেক বেড়ে যায়।

apple pay

🔥🔥 গুগল নিউজে বাংলাটেক সাইট ফলো করতে এখানে ক্লিক করুন তারপর ফলো করুন 🔥🔥

বাংলাদেশে অ্যাপল পে ব্যবহারের চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশে সরাসরি অ্যাপল পে অফিসিয়ালি সাপোর্ট করে না। এর কয়েকটি কারণ রয়েছে।

প্রথমত, এখনো বাংলাদেশি ব্যাংক বা মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (যেমন বিকাশ, নগদ, রকেট) অ্যাপল পে-এর সঙ্গে চুক্তি করেনি। ফলে স্থানীয় কার্ড বা অ্যাকাউন্ট সরাসরি লিংক করা যায় না।

দ্বিতীয়ত, অনেক আন্তর্জাতিক সার্ভিস বাংলাদেশকে অফিশিয়াল তালিকায় রাখে না, যার মধ্যে অ্যাপলও রয়েছে। এর পেছনে আইনগত, টেকনিক্যাল এবং আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং নেটওয়ার্কের সীমাবদ্ধতা কাজ করে।

তবে এর মানে এই নয় যে বাংলাদেশে অ্যাপল পে একেবারেই ব্যবহার করা যায় না। বরং কিছু বিকল্প উপায় আছে।

বিদেশি কার্ড দিয়ে অ্যাপল পে ব্যবহার

বাংলাদেশে অনেকেই ভ্রমণ করেন বা বিদেশে আত্মীয়স্বজন থাকেন। সেক্ষেত্রে বিদেশি ব্যাংক কার্ড (বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা ইউরোপের কার্ড) যদি আপনার কাছে থাকে, সেটি আইফোনে যোগ করে অ্যাপল পে ব্যবহার করা সম্ভব।

উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনার কাছে কোনো আন্তর্জাতিক ভিসা বা মাস্টারকার্ড ক্রেডিট/ডেবিট কার্ড থাকে যা অ্যাপল পে সমর্থন করে, তাহলে সেটি সহজেই Apple Wallet-এ যোগ করা যায়। এরপর বাংলাদেশে থাকলেও আপনি অনলাইন স্টোরে, দেশী পস মেশিনে, বা আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে অ্যাপল পে দিয়ে পেমেন্ট করতে পারবেন।

ভার্চুয়াল কার্ড বা ফিনটেক সেবা

বাংলাদেশি ব্যবহারকারীরা চাইলে বিদেশি ফিনটেক প্ল্যাটফর্মের সাহায্যে ভার্চুয়াল কার্ড তৈরি করতে পারেন। উদাহরণ হিসেবে Wise, Payoneer বা Revolut-এর মতো সেবা উল্লেখ করা যায়। এসব প্ল্যাটফর্ম থেকে পাওয়া কার্ড সাধারণত অ্যাপল পে-তে যুক্ত করা যায়।

এক্ষেত্রে একটি সমস্যা হলো, এসব সেবা সবসময় বাংলাদেশি ব্যবহারকারীর জন্য সহজলভ্য নয়। তবে যদি আন্তর্জাতিক অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ থাকে, তাহলে অ্যাপল পে ব্যবহারে এটি কার্যকর উপায় হতে পারে।

বাংলাদেশে বাস্তব ব্যবহারিক ক্ষেত্র

বাংলাদেশে অ্যাপল পে ব্যবহার করা যাবে স্থানীয় দোকানের পস মেশিনে এবং অনলাইনে। ধরুন, আপনি কোনো আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইটে সাবস্ক্রিপশন কিনতে চান—যেমন Netflix, iCloud, বা Spotify। এসব ক্ষেত্রে অ্যাপল পে অনেক সময় সরাসরি সাপোর্ট করে।

আবার কিছু আন্তর্জাতিক ই-কমার্স সাইটে অ্যাপল পে ব্যবহার করা যায়। ফলে অনলাইন শপিং বা সফটওয়্যার ক্রয়ে এটি একটি ভালো মাধ্যম হতে পারে।

এছাড়া স্থানীয় রেস্টুরেন্ট, সুপারশপ বা POS মেশিনে অ্যাপল পে ব্যবহার করতে পারবেন সহজেই। যেসব দোকানে কন্টাক্টলেস পেমেন্ট সুবিধা আছে সেগুলোতেই NFC এর কল্যাণে অ্যাপল পে ব্যবহার করা যাবে।

যেভাবে বাংলাদেশে অ্যাপল পে চালু করবেন

বাংলাদেশি ব্যবহারকারীরা চাইলে কিছু ধাপ অনুসরণ করে অ্যাপল পে ব্যবহার করতে পারেন।

প্রথমে, আপনাকে একটি আন্তর্জাতিকভাবে সাপোর্টেড কার্ড সংগ্রহ করতে হবে। এটি হতে পারে বিদেশি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের কার্ড, বা আন্তর্জাতিক ফিনটেক সার্ভিসের ভার্চুয়াল/প্লাস্টিক কার্ড। যেমন পেওনিয়ার, ওয়াইজ, এলিভেট পে, প্রভৃতি।

দ্বিতীয়ত, আপনার আইফোনে Wallet অ্যাপ খুলে সেখানে “Add Card” অপশন থেকে কার্ডের তথ্য যোগ করতে হবে। অনেক সময় ওয়ালেট অ্যাপের মধ্যে কার্ড যোগ করার অপশন না-ও দেখাতে পারে। সেক্ষেত্রে আইফোনের জেনারেল সেটিংসে অ্যাপল পে সাপোর্ট করে এরকম কোনো রিজিওন সেট করে ট্রাই করা যেতে পারে।

এরপর, ভেরিফিকেশন সম্পন্ন হওয়ার পর আপনি অ্যাপল পে ব্যবহার করতে পারবেন অনলাইন লেনদেন বা সমর্থিত POS মেশিনে। দেশে কিংবা বিদেশে, যেখানেই পস মেশিনে এনএফসি সাপোর্ট করবে সেখানেই অ্যাপল পে ব্যবহার করা যাবে বলে আশা করা যায়।

এই কৌশল কিছুটা জটিল হলেও সম্ভব। বিশেষ করে যারা নিয়মিত আন্তর্জাতিক সেবা ব্যবহার করেন, তাদের জন্য এটি অনেক কাজে আসে।

👉 অ্যাপল পে কী? অ্যাপল পে ব্যবহারের নিয়ম ও এর সুবিধা

যেভাবে অ্যাপল পে দিয়ে POS মেশিনে পেমেন্ট করবেন

১. আপনার কার্ড Wallet-এ যোগ করুন

আগেই যেমন বলেছি, প্রথমে আপনার আইফোন বা অ্যাপল ওয়াচে Apple Wallet অ্যাপে গিয়ে একটি সমর্থিত ব্যাংক কার্ড যোগ করতে হবে। কার্ডটি আন্তর্জাতিক ভিসা, মাস্টারকার্ড বা আমেরিকান এক্সপ্রেস হলে ভালো।

২. দোকানে কন্টাক্টলেস POS টার্মিনাল খুঁজুন

যেসব দোকানে NFC-সাপোর্টেড কন্টাক্টলেস POS মেশিন থাকে, সেখানেই অ্যাপল পে ব্যবহার করা যায়। টার্মিনালে সাধারণত ওয়াই-ফাই/ওয়েভ চিহ্ন থাকে।

৩. আইফোন দিয়ে পেমেন্ট

  • আইফোনে সাইড বাটন দ্রুত দু’বার চাপুন (Face ID ফোন হলে)। অথবা অ্যাপল ওয়ালেট অ্যাপ ওপেন করে তারপর সাইড বাটন (হোম বাটন) দ্রুত দুবার চাপুন।
  • Wallet খুলে পেমেন্টের জন্য নির্বাচিত কার্ড দেখাবে।
  • Face ID/Touch ID দিয়ে ভেরিফিকেশন করুন।
  • এরপর ফোনের উপরের অংশ POS মেশিনের কাছে ধরুন।
  • সফল হলে একটি ভাইব্রেশন/বীপ সাউন্ড শোনা যাবে এবং স্ক্রিনে “Done” দেখা যাবে।

৪. অ্যাপল ওয়াচ দিয়ে পেমেন্ট

  • ওয়াচে সাইড বাটন দ্রুত দু’বার চাপুন।
  • নির্বাচিত কার্ড স্ক্রিনে আসবে।
  • ঘড়িটি POS মেশিনের কাছে ধরুন।
  • সফল হলে হালকা ভাইব্রেশন অনুভব করবেন এবং ডিসপ্লেতে কনফার্মেশন দেখা যাবে।

👉 গুগল পে নাকি অ্যাপল পে? কোনটি সেরা? পার্থক্য কী?

মনে রাখার বিষয়

  • POS মেশিন অবশ্যই NFC কন্টাক্টলেস পেমেন্ট সাপোর্টেড হতে হবে।
  • আপনার কার্ড অ্যাপল পে সাপোর্টেড হতে হবে।
  • বাংলাদেশে এখনো স্থানীয় ব্যাংকের কার্ড দিয়ে সম্ভব নয়, তবে বিদেশি কার্ড বা বিদেশে ভ্রমণের সময় সহজেই কাজ করবে।

নিরাপত্তা ও সুবিধা

অ্যাপল পে-এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো নিরাপত্তা। কার্ডের আসল তথ্য কখনো শেয়ার হয় না। প্রতিবার পেমেন্ট করার সময় ফেস আইডি বা টাচ আইডি দিয়ে ভেরিফিকেশন করতে হয়।

এছাড়া আপনার ফোন হারিয়ে গেলে বা চুরি হলে সহজেই Find My iPhone থেকে কার্ড নিষ্ক্রিয় করা যায়। ফলে ঝুঁকি অনেক কম থাকে।

বাংলাদেশে ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি বা অনলাইন ফ্রডের ঘটনা অনেক শোনা যায়। সেই জায়গায় অ্যাপল পে হলে ঝুঁকি কমে যেত। এ কারণে ভবিষ্যতে বাংলাদেশি ব্যাংকগুলো এ প্রযুক্তি চালু করলে ব্যবহারকারীদের জন্য অনেক ভালো হবে।

যেভাবে বাংলাদেশে ডিজিটাল ফাইন্যান্স দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে অ্যাপল পে অফিসিয়ালি চালু হবে। ইতিমধ্যে গুগল পে বাংলাদেশে চালু হয়েছে।

বাংলাদেশে বিকাশ, নগদ বা রকেটের মতো মোবাইল ওয়ালেট যেভাবে জনপ্রিয় হয়েছে, তাতে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোও আগ্রহী হবে। অ্যাপল যদি স্থানীয় ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করে, তাহলে ব্যবহারকারীরা সহজেই আইফোন দিয়ে লেনদেন করতে পারবেন।

👉 গুগল পে ব্যবহারের নিয়ম (বিস্তারিত)

শেষ কথা

বাংলাদেশে অ্যাপল পে অফিসিয়ালি এখনো চালু হয়নি। তবে কিছু কৌশল অবলম্বন করলে ব্যবহারকারীরা আন্তর্জাতিক কার্ড বা ভার্চুয়াল কার্ডের মাধ্যমে এটি ব্যবহার করতে পারেন। অনলাইনে সাবস্ক্রিপশন বা আন্তর্জাতিক শপিংয়ে এটি কার্যকর হলেও স্থানীয় দোকানে এর ব্যবহার এখনো সীমিত।

ডিজিটাল পেমেন্টের দুনিয়ায় অ্যাপল পে এক অনন্য উদ্ভাবন। নিরাপত্তা, গতি এবং ব্যবহারবান্ধব প্রযুক্তির কারণে এটি ভবিষ্যতের জন্য আদর্শ সমাধান হতে পারে। বাংলাদেশেও একদিন এটি অফিসিয়ালি চালু হবে, এটাই এখন প্রযুক্তি সচেতন ব্যবহারকারীদের প্রত্যাশা।

আপনি কি অ্যাপল পে ব্যবহার করেছেন? আপনার মতামত ও অভিজ্ঞতা কমেন্টে জানান!

📌 পোস্টটি শেয়ার করুন! 🔥

সর্বশেষ প্রযুক্তি বিষয়ক তথ্য সরাসরি আপনার ইমেইলে পেতে ফ্রি সাবস্ক্রাইব করুন!

Join 8,474 other subscribers

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *