একাধিক ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট রাখা কেন দরকার, জানুন

বর্তমানে বাংলাদেশে ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রসার ও আধুনিকায়ন উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ইন্টারনেট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং, এটিএম, ইমার্জেন্সি লোন, আন্তর্জাতিক লেনদেন – সবকিছুই আমাদের নিত্যদিনের প্রয়োজনীয়তার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একজন সচেতন গ্রাহক হিসেবে আমাদের ব্যাংক ব্যবহারের কৌশলও উন্নত হওয়া উচিত।

আমাদের অনেকেই কেবল একটি মাত্র ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলেই দিনের পর দিন ব্যাংকিং সেবা গ্রহণ করে যাচ্ছি। কিন্তু কখনো ভেবে দেখেছেন, যদি সেই ব্যাংকের সার্ভারে সমস্যা হয়, বা অ্যাকাউন্টে কোনো জটিলতা তৈরি হয়, তখন আপনার আর্থিক কার্যক্রম পুরোপুরি থেমে যাবে? এই ঝুঁকি এড়াতেই একাধিক ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট রাখা জরুরি হয়ে দাঁড়ায়।

শুধু ঝুঁকি নয়, বরং নানা রকম সুবিধাও পাওয়া যায় যখন আপনি একাধিক ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট রাখেন। নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো কেন বাংলাদেশের একজন সাধারণ গ্রাহকের জন্য এই সিদ্ধান্তটি কার্যকর হতে পারে।

একটি ব্যাংকের উপর নির্ভরশীলতা কমানো

একটি মাত্র ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল থাকলে অনেক সময় আপনি ব্যাকআপ অপশন হারাবেন। ধরুন কোনো বিশেষ সময়ে ব্যাংকের অ্যাপ কাজ করছে না, এটিএম বুথে সার্ভার ডাউন, কিংবা অনলাইন পেমেন্ট বন্ধ। এমন অবস্থায় যদি আপনার অন্য একটি ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থাকে, আপনি সহজেই সেটি দিয়ে প্রয়োজনীয় লেনদেন সম্পন্ন করতে পারবেন। বাংলাদেশে কয়েকদিন পরপরই দেখা যায় বিভিন্ন ব্যাংকের উন্নয়নকাজে বিভিন্ন সেবা সাময়িক বন্ধ থাকে। এরকম পরিস্থিতিতে নিজের আর্থিক কাজকর্মে ব্যাঘাত না ঘটাতে চাইলে একাধিক ব্যাংকে একাউন্ট রাখা আবশ্যক।

ব্যাংকভেদে আলাদা সুবিধা গ্রহণ

বাংলাদেশের প্রতিটি ব্যাংক তাদের নিজস্ব পণ্যে আলাদা ধরনের সুবিধা দেয়। কেউ হয়তো বেশি সুবিধা দিচ্ছে সঞ্চয়ী হিসাবের জন্য, কেউ আবার অ্যাকাউন্ট চার্জ নিচ্ছে কম, কেউ মোবাইল অ্যাপে উন্নত ফিচার দিয়েছে, কেউবা বেশি আন্তর্জাতিক কার্ড সাপোর্ট দিচ্ছে। একাধিক ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট থাকলে আপনি সে অনুযায়ী ব্যাংকের সেরা সুবিধাগুলো বেছে নিতে পারবেন।

money cash

🔥🔥 গুগল নিউজে বাংলাটেক সাইট ফলো করতে এখানে ক্লিক করুন তারপর ফলো করুন 🔥🔥

ব্যবসায়িক ও ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট আলাদা রাখা

উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি মূল ব্যাংক হিসেবে “X” ব্যাংক ব্যবহার করেন, তিনি “Y” বা “Z” ব্যাংকে আরও একটি অ্যাকাউন্ট খুলে সেই ব্যাংকের কার্ড ও অনলাইন ফিচার সুবিধা নিতে পারেন। এতে করে একটি ব্যাংকের সীমাবদ্ধতা অন্য একটি ব্যাংক দিয়ে পূরণ করা সম্ভব হয়।

আপনি যদি কোনো ব্যবসার সাথে যুক্ত থাকেন বা ফ্রিল্যান্সার হন, তাহলে ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক লেনদেন আলাদা রাখা অত্যন্ত জরুরি। এতে করে হিসাব পরিষ্কার থাকে, আয়কর রিটার্ন দিতে সহজ হয়, এবং ভবিষ্যতে লোন নেওয়ার সময় ব্যাংক আপনার আর্থিক ইতিহাস সহজে যাচাই করতে পারে।

সময় ও অবস্থানভেদে ব্যাংক ব্যবহারের সুবিধা

সব সময় সব ব্যাংকের শাখা বা এটিএম আপনার কাছাকাছি থাকবে না। আবার কোনো ব্যাংকের সার্ভার কিংবা কার্ডে সমস্যা দেখা দিতে পারে। একাধিক ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট থাকলে আপনি সেই মুহূর্তে যে ব্যাংকের শাখা বা সেবা সহজলভ্য, সেটিই ব্যবহার করতে পারবেন।

বিশেষ করে ভ্রমণের সময়, কোনো ব্যাংকের বুথ কাজ না করলে কাছাকাছি থাকা অন্য ব্যাংকের কার্ড ব্যবহার করে টাকা উত্তোলন বা লেনদেন করা যায়। এতে করে সময় ও যাত্রা ব্যাহত হয় না।

👉 ব্যাংক লোন পাওয়ার উপায়

লোন ও ক্রেডিট সুবিধার প্রসার

আপনার যদি ভবিষ্যতে হোম লোন, পার্সোনাল লোন বা গাড়ির লোন নেওয়ার ইচ্ছে থাকে, তাহলে একাধিক ব্যাংকে দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ক রাখলে আপনি তুলনামূলক ভালো অফার ও দ্রুত অ্যাপ্রুভাল পেতে পারেন। এতে আপনার ব্যাঙ্কিং ইতিহাসও আরও ভারসাম্যপূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য হয়।

এছাড়া কিছু ব্যাংক তাদের পুরাতন গ্রাহকদের জন্য প্রিফার্ড কাস্টমার লোন অফার দিয়ে থাকে—যেখানে কম ইন্টারেস্ট রেট ও কম ডকুমেন্টেশনে লোন পাওয়া সম্ভব। এসব সুবিধা নেওয়ার জন্য একাধিক ব্যাংকে ট্র্যাক রেকর্ড থাকা কাজে লাগে।

অনলাইন লেনদেনে ব্যাকআপ

অনলাইনে পেমেন্ট করতে গিয়ে অনেক সময় কোনো কোনো ব্যাংকের কার্ড ব্যর্থ হয় বা OTP আসে না। তখন অন্য ব্যাংকের ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড দিয়ে লেনদেন সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। এটি অনলাইন কেনাকাটায় আপনার নির্ভরযোগ্যতা বাড়িয়ে দেয়।

বিশেষ করে ই-কমার্স সাইটে, সরকারি পেমেন্ট বা ফ্লাইট বুকিংয়ের সময় একাধিক বিকল্প থাকা আপনার সময় বাঁচাতে ও মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে।

মোবাইল ব্যাংকিং ও ফান্ড ট্রান্সফারের সুবিধা

অনেক ব্যাংক এখন bKash, Nagad, অথবা আন্তঃব্যাংক ফান্ড ট্রান্সফার (NPSB/BEFTN/RTGS) সেবা দিচ্ছে। একাধিক ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট থাকলে আপনি এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে সহজেই টাকা পাঠাতে পারেন। এতে করে আপনার আর্থিক নিয়ন্ত্রণ আরও স্মার্ট হয়।

এছাড়া কিছু ব্যাংকে এখন GPAY, Tap, NexusPay ইত্যাদি নতুন ডিজিটাল ওয়ালেট লিংক করার সুবিধা রয়েছে। একাধিক অ্যাকাউন্ট থাকলে আপনি সহজেই এগুলো লিংক করতে পারেন।

👉 ইন্টারনেট ব্যাংকিং কি? অনলাইন ব্যাংকিং এর সুবিধা অসুবিধা জানুন

আন্তর্জাতিক লেনদেনের সুযোগ

যারা ইউটিউব, অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং, ফ্রিল্যান্সিং বা রিমোট জব করেন, তাদের জন্য ডলার অ্যাকাউন্ট অপরিহার্য। কিন্তু সব ব্যাংকে এই সেবা সহজলভ্য নয়। কিছু নির্দিষ্ট ব্যাংকে আন্তর্জাতিক লেনদেনের সুবিধা বেশি। যেমন, সিটি ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ইত্যাদি ডলার কার্ড, Payoneer বা Swift transfer সহজ করে দিয়েছে।

আপনার যদি একাধিক ব্যাংকে ডলার অ্যাকাউন্ট থাকে, তবে যেকোনো সমস্যা হলে আপনি বিকল্প চ্যানেল ব্যবহার করে ইনকাম তুলতে পারবেন।

সার্ভিস চার্জ ও অফার কম্পেয়ার

একাধিক ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট রাখলে আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন কোন ব্যাংক কম চার্জ নিচ্ছে, বা কোথায় সুদের হার বেশি। আপনি তখন স্মার্টলি টাকা স্থানান্তর করে নিজের লাভের পরিমাণ বাড়াতে পারবেন। কেউ হয়তো অফার দিচ্ছে একটি কার্ডে ডিসকাউন্ট, আবার অন্যটি দিচ্ছে EMI সুবিধা—উভয়টিই আপনি ব্যবহার করতে পারবেন।

বড় মার্কেটপ্লেস যেমন Daraz, Foodpanda ইত্যাদিতে প্রায়ই বিভিন্ন ব্যাংকের সাথে যৌথ অফার চলে। একাধিক ব্যাংকের কার্ড থাকলে আপনি এগুলোর সুবিধা সহজেই নিতে পারবেন।

👉 ক্রেডিট কার্ড ও ডেবিট কার্ড নিরাপদ রাখার উপায়

জরুরি প্রয়োজনে অতিরিক্ত নিরাপত্তা

অনেক সময় দেখা যায়, কেউ প্রতারণার মাধ্যমে আপনার একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে ফেলেছে বা ব্লক করা হয়েছে। তখন যদি অন্য কোনো ব্যাংকে বিকল্প অ্যাকাউন্ট না থাকে, আপনার আর্থিক কার্যক্রম পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে যাবে। তাই একাধিক ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট রাখা মানে একটি আর্থিক নিরাপত্তার জাল তৈরি করা।

এছাড়া বিদেশ ভ্রমণের সময়, একটি ব্যাংকের কার্ড কাজ না করলে অন্য ব্যাংকের কার্ড দিয়ে জরুরি খরচ চালানো সম্ভব হয়। এতে করে মানসিক প্রশান্তিও মেলে।

একাধিক ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট রাখা মানেই কেবল বাড়তি ঝামেলা নয় – বরং এটি একটি দূরদর্শী ও কৌশলী সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশের বর্তমান আর্থিক ব্যবস্থায় এটি হয়ে উঠেছে সময়ের দাবি। হোক সেটা অনলাইন শপিং, মাসিক বিল পরিশোধ, ব্যবসায়িক লেনদেন বা আন্তর্জাতিক ইনকাম- একাধিক ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট থাকলে আপনি হবেন আরও দক্ষ, স্বাধীন ও সুরক্ষিত।

তবে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, আপনার প্রতিটি অ্যাকাউন্ট যেন সক্রিয় থাকে এবং অপ্রয়োজনে কোনো ফি না কাটে। সময়মতো ট্রানজ্যাকশন, অ্যাকাউন্ট মেইনটেনেন্স ও সাইবার নিরাপত্তার বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে পারলে, আপনি পুরো ব্যাংকিং অভিজ্ঞতাকেই আরও কার্যকর করে তুলতে পারবেন।

📌 পোস্টটি শেয়ার করুন! 🔥

সর্বশেষ প্রযুক্তি বিষয়ক তথ্য সরাসরি আপনার ইমেইলে পেতে ফ্রি সাবস্ক্রাইব করুন!

Join 8,519 other subscribers

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *