প্রতি বছর রমজান মাস আসে আমাদের সংযম ও আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের পরীক্ষা নিয়ে। সারাদিন রোজা পালন করে মুসলমানগন আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে চান। আর রোজার দুটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল সেহরি ও ইফতার। সঠিকভাবে সেহরি ও ইফতার পালন না করলে আপনার রোজা হালকা বা ভঙ্গ হয়ে যেতে পারে। তাই সেহেরি ও ইফতারের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমাদের ধারণা থাকা অত্যন্ত জরুরি। সঠিক সময়ে সেহেরি ও ইফতার সম্পন্ন করা রোজার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। এই সময় নিয়মিত এলাকাভেদে পরিবর্তন হয়। এছাড়া এজন্য প্রতিদিন কোন নির্দিষ্ট একটি সময় থাকে না। আর তাই প্রতিদিন নতুন ও সঠিক সময় জেনে নেয়া একজন রোজাদারের কর্তব্য। এছাড়াও সেহরিতে সঠিকভাবে খাওয়া ও সেহরির সাথে সংযুক্ত আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাতও জেনে নেয়া প্রয়োজন। রোজার পুরো মাসটিতে আমাদের দৈনন্দিন রুটিন পরিবর্তন হয়ে যায় বলে স্বাস্থ্যের ব্যাপারেও নজর রাখা প্রয়োজন।
এই পোস্টে আপনি পুরো রমজান মাসের এবং অন্যান্য সময়ের প্রতিদিনের সেহরির শেষ সময় ও ইফতারের সময় নিয়ে জেনে নিতে পারবেন। সেই সঙ্গে সেহরির বিষয়ে আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নিয়েও আলোচনা করা হবে।
সেহরির গুরুত্ব ও সঠিক সময়ে কেন সেহরি করা উচিত
রোজার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ রয়েছে যা রোজাকে পরিপূর্ণ করে। আর রোজার প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ এই অনুষঙ্গটি হল সেহরি। সেহরি শব্দের আভিধানিক অর্থ শেষ রাতের খাবার। রোজা পালনের উদ্দেশ্যে মুসলিমগণ সুবহে সাদিক বা সূর্য উঠবার পূর্বেই যে খাবার খান তাকেই মূলত সেহরি বলা হয়ে থাকে।
সেহরি একটি সুন্নত কাজ এবং নবীজি (সা.) এর উপর অনেক গুরুত্ব প্রদান করেছেন। সেহরি রোজা পালনকে সহজ করে দেয় এবং শরীরকে ঠিক রাখে। সঠিকভাবে সেহরি করার মাধ্যমে আপনি রমজান মাসে আপনার দেহকে সুস্থ ও সবল রাখতে পারেন। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা সেহরি খাও, কেননা সেহরিতে রয়েছে বরকত।’ (বুখারি, হাদিস: ১৮০১)। অর্থাৎ সেহেরি খাওয়ার মধ্যে অনেক উপকার রয়েছে যা আমরা খোলা চোখে নাও বুঝতে পারি। রোজা থাকা মানে উপবাস থাকা। আর উপবাস থাকার এই প্রক্রিয়াটি অন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রেও প্রচলন আছে। তবে মুসলমানদের জন্য এই উপবাস থাকার অন্যতম পার্থক্য সেহেরি খাওয়া।
ইফতার ও সেহরি দুটি জিনিসই সময়মতো নিয়ম মেনে করা অত্যন্ত জরুরি একজন মুসলিমের জন্য। সেহরির ক্ষেত্রে সতর্কতা আরও ভালো করে অবলম্বন করা প্রয়োজন। কেননা সূর্য উদয় হলেই বোঝা সম্ভব নয়। তাই সঠিক সময় জেনে এরপর তার আগেই সেহরি ভালোভাবে শেষ করে ফেলা প্রয়োজন যাতে করে যথেষ্ট সময় হাতে থাকে রোজা শুরু করবার প্রস্তুতির জন্য। সেহরির সময় কখন শুরু হয় এটি নিয়েও অনেকের মতামত দেখা দেয়। এ বিষয়ে অনেক আলেম-ওলামা বলেছেন যে অর্ধরাত্রি থেকে সেহরির সময় শুরু হয়।
অর্থাৎ অর্ধরাত্রি হতে সুবহে সাদিকের পূর্ব পর্যন্ত সময়টুকু হচ্ছে সেহরি করার সময়। এটি সবথেকে প্রসিদ্ধ মত। তবে ইফতারের ক্ষেত্রে যেমন ওয়াক্ত হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই ইফতার করা সুন্নাত সেহরির ক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টো। অর্থাৎ সেহরি দেরি করে করাই সুন্নত। তবে অবশ্যই তা নিরাপদ সময়ের মধ্যে শেষ করে ফেলতে হবে। সেহরি এমন সময় শেষ করা ঠিক নয় যাতে সন্দেহ থেকে যায়। অনেকের মনেই এমন ভুল ধারণা রয়েছে যে ফজরের আজানের আগে পর্যন্ত সেহরি খাওয়া যায়। তবে এই ধারণা সম্পূর্ণই ভুল। ইসলামে স্পষ্ট করে সেহরির জন্য সময় নির্ধারণ করা রয়েছে যা সুবহে সাদিকের পূর্ব পর্যন্ত। তাই আজানের আগে পর্যন্ত সেহরি খেলে তা অবশ্যই সে সময়কে অতিক্রম করবে এবং আপনার রোজা ভেঙ্গে যাবে।
সেহরি সময়মতো খাওয়ার মতোই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অবশ্যই সেহরি খাওয়া। রাসুলে কারিম (সা.) এজন্যই বলেছেন, ‘তোমরা সেহরি খাও; যদি তা এক ঢোঁক পানিও হয়।’ অন্য আরেক জায়গায় এসেছে , ‘তোমরা সেহরি খাও; যদি এক লোকমা খাদ্যও হয়।’ (মুসলিম)। অর্থাৎ সেহরি খাওয়া এবং তা সময়মতো খাওয়া খুবই জরুরি একটি ব্যাপার। নবীজির এই উক্তি থেকে বোঝা যায় যে যে কোন পরিমাণ সেহরি গ্রহণ করাই সেহরির ইবাদত পালনের পক্ষে যথেষ্ট। সেহরি খাওয়াটাই মূল কথা। ইচ্ছা করে সেহরি না খাওয়া থেকে তাই বিরত থাকা প্রয়োজন।
সেহরি খাওয়ার পর পর আজান হয়ে গেলে ফজরের নামাজ পড়ে আর না ঘুমানো আরেকটি সুন্নত কাজ। তাই আর না ঘুমিয়ে দিন শুরু করলে আপনার শরীর ও স্বাস্থ্য যেমন ভালো থাকবে তেমনি নবীজির সুন্নতও পালন হয়ে যাবে। অনেকেই সারারাত না ঘুমিয়ে একবারে সেহরি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। এটি ভালো অভ্যাস নয়। এতে করে আপনার অসুস্থ হওয়ার শঙ্কা বেড়ে যাবে এবং সারাদিন ক্লান্তি দেখা দিতে পারে।
🔥🔥 গুগল নিউজে বাংলাটেক সাইট ফলো করতে এখানে ক্লিক করুন তারপর ফলো করুন 🔥🔥
সেহরির উপর এতো গুরুত্ব আরোপ করার অন্যতম কারণ সেহরি খেতে আপনাকে রাতের ঘুম ভেঙ্গে কষ্ট করে উঠতে হয়। অর্থাৎ এটি রোজা রাখার প্রতি এবং আল্লাহর নির্দেশনা মানার প্রতি আগ্রহের প্রকাশ। আল্লাহ তায়ালা বান্দার এই চেষ্টা দেখে খুশি হন। এটি রমজান মাসের গুরুত্বপূর্ণ এক ইবাদত। আল্লাহ তায়ালা রাত্রির এই সময়কে পছন্দ করেন এবং এই সময় তাই পবিত্র একটি সময়। এসময় তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করে আল্লাহর নিকট দোয়া করলে তা কবুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা কোরআনে বলেছেন, ‘তারা (মুমিনগণ) রাত্রির শেষ অংশে আল্লাহর নিকট ইস্তিগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) করে থাকে।’ (সুরা-৫১ জারিয়াত, আয়াত: ১৮)।
অর্থাৎ সেহরির ফজিলত অনেক। সেহরির মাধ্যমে আল্লাহর রাসুলের সুন্নত অনুসরণ করার মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের প্রকাশ হয়। আর আল্লাহ তায়ালার কাছে তাই এটি অত্যন্ত পছন্দনীয়। এছাড়া সারাদিন ইবাদত করার এবং রোজা রাখার শক্তিও সঞ্চয় করা যায় সেহরি খাবার মাধ্যমে। সেহরি আপনাকে সারাদিন পরিশ্রম করে রোজা রাখার কষ্টকে অনেকটাই লাঘব করে দেয়। এতে আপনার মন প্রফুল্ল থাকে এবং স্বাস্থ্য ভালো থাকে। আর সেহরির সঠিক সময় জেনে নিয়ে ঠিক সময়ের কিছু আগেই আহার শেষ করা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। এর মাধ্যমে আপনি আপনার রোজা সঠিকভাবে শুরু করতে পারবেন এবং ভালোভাবে পালন করার সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করে ফেলতে পারবেন।
আজকের সেহরির সময়
নিচের ছকে সারা বছরের সেহরি ও ইফতারের সময় দেয়া হল। এটা ঢাকা জেলার জন্য প্রযোজ্য হলেও কয়েক মিনিট যোগ/বিয়োগ করে আপনি আপনার জেলার জন্য সেহরি ইফতার টাইম জেনে নিতে পারেন। কোন জেলার জন্য কত মিনিট যোগ-বিয়োগ করা দরকার হবে তা জানতে নিচে আরেকটি আলাদা ছক দেওয়া হয়েছে। উভয় ছক দেখে আপনার এলাকার জন্য রোজার সময় জেনে নিন।
প্রথম ছকঃ
দ্বিতীয় ছকঃ
রমজান মাসের সেহরি ও ইফতারের ক্যালেন্ডার
ছক থেকে রমজান মাসের সেহরির শেষ সময় দেখে নিতে পারেনঃ
উপরের ছক শুধুমাত্র ঢাকা জেলার জন্য প্রযোজ্য। বিভিন্ন এলাকার জন্য সময় যোগ বা বিয়োগ করে নিতে হবে। কোন জেলায় কত সময় যোগ বা বিয়োগ করতে হবে তা নিচের ছক থেকে জেনে নিতে পারেন।
সেহরির দোয়া
সেহরির সময় একটি পবিত্র সময়। অর্ধরাত্রির পর থেকে সুবহে সাদিকের আগ পর্যন্ত সময়টুকুতে দোয়া করতে থাকলে তা কবুল হবার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। এসময় নিজের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা ও নিজের মতো করে সকল দোয়া করা উচিত। আল্লাহ তায়ালা রাত জেগে বান্দার এই প্রার্থনাকে পছন্দ করেন। এছাড়াও সেহরির সময় নবীজি একটি দোয়া পড়তেন। এই দোয়াটিও চাইলে পড়তে পারেন। দোয়াটি হচ্ছে, ‘নাওয়াইতু আন আছুম্মা গাদাম মিন্ শাহরি রমাজানাল মুবারাকি ফারদাল্লাকা, ইয়া আল্লাহু ফাতাকাব্বাল মিন্নি ইন্নিকা আনতাস্ সামিউল আলিম।’ এর অর্থ হল, ‘হে আল্লাহ! আমি আগামীকাল পবিত্র মাহে রমজানের নির্ধারিত ফরজ রোজা রাখার নিয়ত করলাম। অতএব তুমি আমার রোযা তথা পানাহার থেকে বিরত থাকাকে কবুল কর, নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞানী।’
সেহরিতে কী খাওয়া উচিত?
রোজায় শরীর ও স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে নিয়ম মেনে ও সতর্ক থেকে ইফতার ও সেহরি করা জরুরি। আর তাই সেহরিতে সঠিক খাবার বাছাই করতে হবে। সেহরিতে স্বাস্থ্যকর এবং দীর্ঘসময় আপনাকে শক্তি দেবে এমন খাবার খাওয়া প্রয়োজন। ইফতারে আমরা আলাদা গুরুত্ব প্রদান করলেও সেহরির ক্ষেত্রে অনেক সময়ই আলাদাভাবে চিন্তা করি না। কিন্তু সেহরিও অনেক গুরুত্ব ধারণ করে। রোজায় যাতে অতিরিক্ত ক্লান্তি না আসে এজন্য সেহরির প্রতি আমাদের আলাদা দৃষ্টি রাখা উচিত।
সেহরি করাটাই রোজা পালনের জন্য মুখ্য ব্যাপার। আপনি কতটুকু খাবেন বা কী খাবেন সে ব্যাপারে আলাদা কোন ব্যাপার নেই। তবে ইফতারের মতো সেহরির খাবারও হতে হবে হালাল উপার্জনে হালাল খাবার। স্বাস্থ্য সচেতন হলে খাবার বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও আলাদা দৃষ্টি রাখতে পারেন।
যেসব খাবার আঁশযুক্ত সেগুলো আমাদের শরীর শোষণ করে নিতে সময় নেয় অন্যান্য খাবার থেকে। ফলে এসব খাবার আমাদের শরীরকে দীর্ঘক্ষণ শক্তি যোগাতে পারে এবং ক্ষুধাও কম পায়। তাই সেহরিতে আঁশযুক্ত বিভিন্ন খাবার রাখতে পারেন। আঁশযুক্ত খাবারের মধ্যে আছে কলা, আম, গাজর, আপেল, বাদাম, ডাল ইত্যাদি। এসব খাবার একইসাথে যেমন স্বাস্থ্যকর তেমনি আপনাকে সারাদিন চলার মতো শক্তি দিতে পারে। সেহরিতে ডিম খাওয়া উচিত। এতে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন থাকে বলে শরীরে বেশি সময় শক্তি দিতে পারে। এছাড়া কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাবারও আপনার শরীরকে ঠিক রাখতে সাহায্য করে। আর তাই পর্যাপ্ত পরিমাণে ভাত, আলু বা দুধজাতীয় খাবার খেতে পারেন সেহরিতে।
পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করার বিকল্প নেই। সারাদিন রোজায় যেহেতু আপনার শরীরে পানি খরচ হবে তাই এই ঘাটতি সেহরিতেই পূরণ করে ফেলা উচিত। এতে আপনার খাবার সহজে হজম হবে এবং সারাদিনের পানিশুন্যতা থেকেও বাঁচতে পারবেন।
সেহরিতে চা, কফি বা ক্যাফেইনযুক্ত খাবার খাওয়া উচিত নয়। এতে আপনার তৃষ্ণা বেড়ে যাবে। এছাড়া সেহরিতে অত্যধিক পরিমাণে খাওয়াও পরিহার করা উচিত। অত্যধিক খেলে আপনার পাকস্থলিতে চাপ পড়ে এবং হজমেও সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। পর্যাপ্ত পরিমাণ খাওয়া শরীরের জন্য ভালো এবং সারাদিনে আপনাকে সুস্থ রাখতেও সাহায্য করবে। পানি পানের ক্ষেত্রেও প্রয়োজনের অতিরিক্ত পান করা উচিত নয়। এটিও হজমের সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। আপনার দেহের যতটুকু প্রয়োজন সেটুকুই পান করা উচিত।
রোজার মূল উদ্দেশ্য সংযমের চর্চা করা। আর তাই একে আহারের উৎসবে পরিনত করা থেকে সকলেরই বিরত থাকা উচিত। সেহরি ও ইফতারের সঠিক সময় ও নিয়ম মেনে রোজার পবিত্রতা রক্ষা করা সকল মুসলমানেরই দায়িত্ব। তাই এসব দিকে আমাদের আরও বেশি সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
- বাংলাটেক ফেসবুক গ্রুপে যোগ দিয়ে প্রযুক্তি বিষয়ক যেকোনো প্রশ্ন করুনঃ এখানে ক্লিক করুন।
- বাংলাটেক ফেসবুক পেইজ লাইক করে সাথে থাকুনঃ এই পেজ ভিজিট করুন।
- বাংলাটেক ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করতে এখানে ক্লিক করুন এবং দারুণ সব ভিডিও দেখুন।
- গুগল নিউজে বাংলাটেক সাইট ফলো করতে এখানে ক্লিক করুন তারপর ফলো করুন।
- বাংলাটেক সাইটে বিজ্ঞাপন দিতে চাইলে যোগাযোগ করুন এই লিংকে।
- প্রযুক্তির সব তথ্য জানতে ভিজিট করুন www.banglatech24.com সাইট।