ফেসবুক মেসেঞ্জার অ্যাপ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ডেস্কটপে 

দীর্ঘদিন ধরে ফেসবুক মেসেঞ্জার আমাদের অনলাইন যোগাযোগের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। কিন্তু প্রযুক্তি দ্রুত বদলে যাচ্ছে, আর সেই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছে এর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মেটা। সম্প্রতি জানানো হয়েছে যে, মেটা ডিসেম্বর ১৫, ২০২৫ থেকে উইন্ডোজ ও ম্যাক কম্পিউটারের জন্য মেসেঞ্জার ডেস্কটপ অ্যাপ বন্ধ করে দেবে। অর্থাৎ ওই তারিখের পর থেকে আপনি আর সেই নেটিভ অ্যাপ খুলে লগ ইন করতে পারবেন না।

মেটার এই ঘোষণা অনেকের জন্য বিস্ময়কর হলেও কোম্পানির সাম্প্রতিক কৌশল ও দিকনির্দেশনার সঙ্গে এটি বেশ সামঞ্জস্যপূর্ণ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো? আর এর ফলে সাধারণ ব্যবহারকারীরা কী প্রভাব অনুভব করবেন?

কেন বন্ধ হচ্ছে ডেস্কটপ সংস্করণ?

মেটার অভ্যন্তরীণ পরিকল্পনা অনুসারে, প্রতিষ্ঠানটি এখন তাদের পণ্যগুলোকে আরও একীভূত ও ওয়েবভিত্তিক করে তুলছে। ডেস্কটপ অ্যাপের ব্যবহারকারীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কমে গেছে, কারণ এখন অধিকাংশ মানুষই ব্রাউজারের মাধ্যমেই ফেসবুক ও মেসেঞ্জার ব্যবহার করেন। সেই বাস্তবতায়, ডেস্কটপ অ্যাপের রক্ষণাবেক্ষণ ও আপডেট চালিয়ে যাওয়া হয়তো আর অর্থনৈতিকভাবে যুক্তিযুক্ত নয়।

২০২৪ সালে মেটা মেসেঞ্জারের একটি প্রগ্রেসিভ ওয়েব অ্যাপ (PWA) সংস্করণ চালু করে, যা ওয়েব ব্রাউজারেই ডেস্কটপ অভিজ্ঞতা দেয়। তাই অনেক দিক থেকেই এটি ডেস্কটপ অ্যাপের বিকল্প হয়ে উঠেছে। PWA প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে মেটা এখন একক প্ল্যাটফর্মে সবার জন্য একই অভিজ্ঞতা দিতে পারছে — আলাদা কোডবেস বা রক্ষণাবেক্ষণের ঝামেলা ছাড়াই।

এই সিদ্ধান্তের আরেকটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে নিরাপত্তা ও আপডেট ব্যবস্থাপনা। ডেস্কটপ অ্যাপগুলোকে নিয়মিত আপডেট দেওয়া, নতুন ফিচার যোগ করা ও সিকিউরিটি ফিক্স দেওয়া সবসময়ই জটিল ও ব্যয়বহুল কাজ। ওয়েবভিত্তিক সেবায় এই প্রক্রিয়া অনেক সহজ হয়। ব্যবহারকারীর কাছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপডেট পৌঁছে যায়, ডাউনলোড বা ইনস্টলেশনের প্রয়োজন পড়ে না।

facebook messenger

🔥🔥 গুগল নিউজে বাংলাটেক সাইট ফলো করতে এখানে ক্লিক করুন তারপর ফলো করুন 🔥🔥

ব্যবহারকারীদের জন্য এর অর্থ কী?

যারা দীর্ঘদিন ধরে মেসেঞ্জারের ডেস্কটপ সংস্করণ ব্যবহার করছেন, তাদের জন্য এটি নিঃসন্দেহে একটি বড় পরিবর্তন। ডিসেম্বরের ১৫ তারিখের পর তারা আর সেই অ্যাপে লগ ইন করতে পারবেন না। পরিবর্তে, তাদেরকে ফেসবুকের ওয়েব সংস্করণ অথবা উইন্ডোজে থাকা ফেসবুক ডেস্কটপ অ্যাপ ব্যবহার করতে হবে।

এই পরিবর্তনের ফলে অনেকের কাজের ধরণেও প্রভাব পড়বে। অফিস বা বাড়িতে যারা ডেস্কটপ অ্যাপে মেসেঞ্জার চালিয়ে রাখতেন, তারা আর সেই সুবিধা পাবেন না। তাদের এখন ব্রাউজারের ট্যাব খুলে মেসেঞ্জার ব্যবহার করতে হবে, যা কিছুটা হলেও মনোযোগ ব্যাহত করতে পারে।

অন্যদিকে, যারা ব্রাউজার বা মোবাইল অ্যাপে অভ্যস্ত, তাদের জন্য এটি কোনো বড় সমস্যা নয়। মেটা ইতিমধ্যেই নিশ্চিত করেছে যে, ফেসবুক সাইটেই মেসেঞ্জারের সব মূল ফিচার থাকবে — যেমন চ্যাট, ভয়েস কল, ভিডিও কল, রিঅ্যাকশন, রিড রিসিপ্ট, এমনকি এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশনও।

নিরাপত্তা ও তথ্য সংরক্ষণের নির্দেশনা

মেটা ব্যবহারকারীদের সতর্ক করেছে যাতে তারা চ্যাট ইতিহাস ও ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষিত রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেন। বিশেষ করে “secure storage” চালু রাখা ও একটি পিন সেট করা গুরুত্বপূর্ণ। এতে করে পুরোনো বা সংবেদনশীল বার্তাগুলো ভবিষ্যতে হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি কমবে।

ডেস্কটপ অ্যাপটি বন্ধ হওয়ার পরও ওয়েবে মেসেঞ্জার ব্যবহার করার সময় আপনার ডেটা নিরাপদ থাকবে। মেটা তাদের সার্ভার সাইডে এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন প্রযুক্তি আরও উন্নত করেছে, ফলে ওয়েব ভার্সনেও চ্যাট নিরাপদ থাকবে। তাই ডেস্কটপ অ্যাপ বন্ধ হয়ে গেলেও নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।

তবে যেসব ব্যবহারকারী ডেস্কটপ অ্যাপের মাধ্যমে কিছু বিশেষ মিডিয়া ফাইল সংরক্ষণ করেছেন, তারা চাইলে আগেই সেগুলোর ব্যাকআপ নিয়ে রাখতে পারেন। এতে প্রয়োজনীয় তথ্য হারানোর আশঙ্কা থাকবে না।

👉 বিটিসিএল আনবে নতুন মোবাইল সিম, থাকছে যেসব সুবিধা

ওয়েব অভিজ্ঞতার নতুন ধারা

মেটা শুধু ডেস্কটপ নয়, তাদের অন্যান্য সেবাগুলোতেও ওয়েব-কেন্দ্রিক কাঠামো তৈরি করছে। ইনস্টাগ্রাম, থ্রেডস কিংবা হোয়াটসঅ্যাপ ওয়েব—সব জায়গাতেই দেখা যাচ্ছে একধরনের প্রযুক্তিগত ঐক্য। এটি মূলত “one ecosystem” ভাবনার ফল, যেখানে ব্যবহারকারীকে আলাদা অ্যাপ ডাউনলোড না করেই একই অভিজ্ঞতা দেওয়া যায়।

এই প্রেক্ষাপটে, মেসেঞ্জারের ডেস্কটপ অ্যাপ বন্ধ হওয়াকে কেবল একটি অ্যাপের সমাপ্তি হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। বরং এটি ওয়েব-প্রাধান্য প্রযুক্তির যুগে একটি স্বাভাবিক বিবর্তন। ভবিষ্যতে মেটা হয়তো তাদের ওয়েব প্ল্যাটফর্মকে আরও ইন্টিগ্রেটেড করে তুলবে, যেখানে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও থ্রেডসের মেসেজিং এক জায়গায় মিলিত হবে।

বাংলাদেশে ব্যবহারকারীদের প্রভাব

বাংলাদেশে মেসেঞ্জার শুধু ব্যক্তিগত চ্যাট নয়, ছোট ব্যবসা, অনলাইন বিক্রেতা এবং গ্রাহকসেবার একটি বড় মাধ্যম। অনেক দোকানদার ডেস্কটপ অ্যাপ ব্যবহার করে দ্রুত বার্তা পাঠানো বা গ্রাহকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। তারা হয়তো কিছুটা অসুবিধায় পড়বেন। তবে ওয়েব সংস্করণে একই কাজ করা সম্ভব, এবং মেটার লক্ষ্যই হলো সবাইকে সেই প্ল্যাটফর্মে নিয়ে যাওয়া।

এছাড়া অনেকেই ডেস্কটপ নোটিফিকেশন ও দ্রুত উত্তর দেওয়ার জন্য এই অ্যাপ ব্যবহার করতেন। এখন তাদেরকে ব্রাউজারে “notification permission” চালু রাখতে হবে, যাতে নতুন বার্তা এলে তা সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায়। ফেসবুক ওয়েব ভার্সনে এই সুবিধা আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে।

👉 NID’তে সর্বোচ্চ ১০টি সিম – অতিরিক্ত সিম বন্ধ করবে বিটিআরসি

প্রযুক্তি দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন

প্রযুক্তি বিশ্লেষকদের মতে, মেটার এই পদক্ষেপ আসলে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ। তারা এখন হালকা, একীভূত এবং সহজে আপডেটযোগ্য সেবা দিতে চায়। ওয়েবভিত্তিক অ্যাপ সেই সুযোগই করে দেয়। একই সঙ্গে এটি পরিবেশবান্ধব ও ডিভাইস-স্বাধীন সমাধান।

তবে ডেস্কটপ অ্যাপের বিশেষ কিছু সুবিধা ছিল, যেমন বড় স্ক্রিনে নিরবচ্ছিন্ন চ্যাট, কম সিস্টেম লোড, এবং অন্যান্য অ্যাপ থেকে আলাদা থাকা। এই দিকগুলো হারিয়ে যাওয়ায় অনেকের কর্মদক্ষতা কিছুটা কমে যেতে পারে। মেটা হয়তো ভবিষ্যতে ওয়েব সংস্করণে নতুন কিছু ফিচার যোগ করে সেই ঘাটতি পূরণ করবে।

ভবিষ্যতের দিকে নজর

এই পরিবর্তন নিঃসন্দেহে দেখিয়ে দিচ্ছে যে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো ক্রমেই ওয়েবকে প্রাথমিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গুরুত্ব দিচ্ছে। ব্রাউজার এখন আর কেবল ওয়েবসাইট খোলার মাধ্যম নয়; এটি হয়ে উঠেছে পূর্ণাঙ্গ অ্যাপ ইকোসিস্টেম। ফলে ভবিষ্যতে হয়তো আমাদের ডেস্কটপে আলাদা করে অ্যাপ ইন্সটল করার প্রয়োজনই থাকবে না।

মেটার এই সিদ্ধান্ত হয়তো অনেকের কাছে নেতিবাচক মনে হতে পারে, কিন্তু এটি বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে একধরনের কৌশলগত রূপান্তর। যে প্রতিষ্ঠান একসময় ফেসবুক ওয়েব থেকে মেসেঞ্জারকে আলাদা করেছিল, তারা এখন আবার সেটিকে মূল প্ল্যাটফর্মে ফিরিয়ে আনছে। ইতিহাস যেন এক পূর্ণ বৃত্তে ঘুরে আসছে।

👉 শাওমি ১৭ প্রো ম্যাক্স: ডুয়াল ডিসপ্লে ও দানবীয় ব্যাটারির নতুন অধ্যায়?

শেষ কথা

মেটার মেসেঞ্জার ডেস্কটপ অ্যাপ বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রযুক্তির এক পরিবর্তনশীল যুগের প্রতিফলন। এটি শুধু একটি অ্যাপ বন্ধ হওয়া নয়, বরং যোগাযোগ ব্যবস্থার নতুন ধারা শুরু হওয়ার ইঙ্গিত। ব্যবহারকারীদের এখন ধীরে ধীরে ওয়েবভিত্তিক ব্যবহারে অভ্যস্ত হতে হবে, যেখানে আপডেট ও সুরক্ষা উভয়ই আরও সহজভাবে পাওয়া যাবে।

এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে মেটা দেখিয়ে দিয়েছে, তারা মোবাইল ও ওয়েব—এই দুই প্ল্যাটফর্মের সমন্বয়েই ভবিষ্যৎ গড়তে চায়। ফলে হয়তো কয়েক বছরের মধ্যেই আমরা এমন এক মেসেঞ্জার দেখতে পাব, যা ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপকে একসঙ্গে যুক্ত করবে।

📌 পোস্টটি শেয়ার করুন! 🔥

সর্বশেষ প্রযুক্তি বিষয়ক তথ্য সরাসরি আপনার ইমেইলে পেতে ফ্রি সাবস্ক্রাইব করুন!

Join 8,399 other subscribers

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *