পৃথিবীকে কেন্দ্র করে অসংখ্য স্যাটেলাইট তার চারদিকে ঘুরছে। এসব স্যাটেলাইট আবহাওয়া, যোগাযোগ, পর্যবেক্ষণ সহ নানা কাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক সময়ে এসে স্যাটেলাইট হয়ে উঠেছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক প্রযুক্তি। বড় বড় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, দেশের নিজস্ব স্যাটেলাইট রয়েছে। তবে স্যাটেলাইট এক প্রকার যন্ত্র। আর সকল যন্ত্রই একটি নির্দিষ্ট সময় পর অকেজো হয়ে যায়। যেমনঃ আপনার বাসার টিভি, ফ্রিজ ইত্যাদি একটি নির্দিষ্ট সময় পড়ে নষ্ট হয়ে যায়। তখন এসব যন্ত্রকে ফেলে দিতে হয়। স্যাটেলাইটও নির্দিষ্ট সময় পর এরকম আবর্জনা হয়ে উঠে। তবে স্যাটেলাইটকে চাইলেই ফেলে দেয়া যায় না। তাহলে অকেজো স্যাটেলাইটকে নিয়ে কী করা হয়? আজকের পোস্টে বিস্তারিত আলোচনা থাকবে এই বিষয়টি নিয়েই।
নষ্ট স্যাটেলাইটকে বর্তমানে দুটি উপায়ে সরিয়ে ফেলা হয়। একটি হচ্ছে পুরোপুরি পুড়িয়ে ধ্বংস করে ফেলা এবং অপরটি পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে স্যাটেলাইটকে দূরে সরিয়ে ফেলা। এই দুটি বিষয়েই আমরা বিস্তারিত জেনে নেব। তবে তার আগে জানা প্রয়োজন নষ্ট স্যাটেলাইটকে কেন আমাদের সরাতে হয়। অনেকের মনে হতে পারে যে মহাশূন্য একটি বিশাল জায়গা বলে এখানে নষ্ট স্যাটেলাইট সরিয়ে ফেলার কোন প্রয়োজন নেই। তবে বিষয়টি মোটেও তেমন নয়।
নষ্ট স্যাটেলাইটকে কেন সরিয়ে ফেলতে হয়?
স্যাটেলাইট অকেজো হয়ে পড়লে তাকে আর তার মূল কক্ষপথে রাখা যায় না। কেননা স্যাটেলাইট যে কক্ষে ঘুরতে থাকে সেই কক্ষপথে ইতোমধ্যেই অসংখ্য স্যাটেলাইট রয়েছে। ফলে অকেজো ও মেয়াদউত্তীর্ণ স্যাটেলাইট সেখানে রেখে দিলে নতুন নতুন স্যাটেলাইট পাঠানো ভবিষ্যতে কঠিন হয়ে যাবে।
স্যাটেলাইট অকেজো হয়ে পড়লে তাকে বলা হয়ে ‘স্পেস জাঙ্ক’ বা মহাশূন্যের আবর্জনা। কেননা ইতোমধ্যেই মহাশূন্যে অনেক আবর্জনা তৈরি হয়ে গেছে। এই আবর্জনাগুলো বেশ চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে। কেননা ভবিষ্যতে আরও কার্যকর স্যাটেলাইট ও পৃথিবী থেকে মহাশূন্যে ভ্রমণের ক্ষেত্রে এই আবর্জনা সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
মহাশূন্য যাত্রার প্রথমদিকে এই বিষয়টি নিয়ে তেমন চিন্তা ছিল না। তবে বর্তমানে মহাশূন্যে আবর্জনার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তা যে কোন সময় দুর্ঘটনার জন্ম দিতে পারে। আবর্জনার কোন টুকরোর সাথে কার্যকর কোন স্যাটেলাইট বা রকেটের সংঘর্ষ মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। কক্ষপথে একটি সংঘর্ষ জন্ম দিতে পারে ‘কেস্লার ইফেক্ট’ নামের চেইন রিয়েকশনের। অর্থাৎ একটি সংঘর্ষ আরও অসংখ্য সংঘর্ষের জন্ম দিতে পারে। এই কারণেই বর্তমানে মহাশূন্যে যে কোন কিছু পাঠালে আগে থেকেই সেটি কীভাবে কাজ শেষে সরিয়ে ফেলা হবে সে বিষয়ে পরিকল্পনা করে নেয়া হয়।
কোথায় যায় অকেজো স্যাটেলাইট?
অকেজো স্যাটেলাইটকে দুইভাবে সরিয়ে ফেলা হয়। কীভাবে তা সরিয়ে ফেলা হবে সেটি নির্ধারণ করা হয় স্যাটেলাইটটি পৃথিবী থেকে কতো উপরে রয়েছে তার উপর নির্ভর করে। যদি স্যাটেলাইট পৃথিবী থেকে খুব বেশি উপরের কক্ষে না থাকে তবে স্যাটেলাইটের শেষ জ্বালানী ব্যবহার করে তার গতি রোধ করে ফেলা হয়। ফলে স্যাটেলাইটটি নিজে থেকেই পৃথিবীর দিকে পড়তে থাকে অভিকর্ষজ টানের ফলে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করলে বাতাসের সাথে ঘর্ষণের ফলে এটিতে আগুন ধরে যায় এবং ধীরে ধীরে তা উপরে থাকতেই পুড়ে শেষ হয়ে যায়।
দ্বিতীয় উপায়টি পৃথিবী থেকে দূরের কক্ষপথে থাকলে ব্যবহার করা হয়। দূরের কক্ষপথে থাকলে সেই স্যাটেলাইটকে আরও দূরে ঠেলে সরিয়ে দেয়াই সহজ। এতে আরও কম জ্বালানী খরচ হয়। এক্ষেত্রেও শেষ জ্বালানী ব্যবহার করে স্যাটেলাইটের গতি থামিয়ে দেয়া হয়। পৃথিবী হতে দূরে থাকে বলে অভিকর্ষ বল এখানে কাজ করে না। ফলে একা একাই স্যাটেলাইট মহাশূন্যে আরও দূরে চলে যায়।
স্পেসক্রাফটের কবরস্থান
প্রথম পদ্ধতিতে ছোট স্যাটেলাইটগুলো সহজেই বায়ুমণ্ডলে পুড়ে ছাই হয়ে যেতে পারে। হাজার হাজার মাইল প্রতি ঘণ্টা গতিতে বাতাসের সাথে ঘর্ষণে এসব ছোট স্যাটেলাইটের অবশিষ্ট কিছু আর থাকে না। ফলে এতে করে বাড়তি কোন চিন্তা থাকে না। কিন্তু বড় স্পেস স্টেশন ও স্পেসক্রাফটের জন্য উপায় কী?
বড় কোন স্যাটেলাইট, স্পেসক্রাফট বা স্পেস স্টেশন বায়ুমণ্ডলে পুড়লেও তার কিছু অংশ পৃথিবীতে ভূপাতিত হয়। আর একারণে তাদের জন্য আলাদা করে চিন্তা করতে হয়। কেননা এই অংশগুলো মানুষ বসবাস করে এমন স্থানে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে পড়লে তাতে করে বিশাল ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। আর এজন্যই রয়েছে স্পেসক্রাফটের জন্য বিশেষ কবরস্থান যার অবস্থান প্রশান্ত মহাসাগরে জনমানবহীন স্থানে। এটি প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে মানুষ থেকে দূরে একটি স্থান। বড় স্যাটেলাইট বা স্পেস স্টেশনগুলোকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে নামিয়ে আনা হয় যাতে তার অবশিষ্টাংশ এই স্থানে ভূপাতিত হয়।
কক্ষপথের কবরস্থান
বেশি উঁচুতে থাকা স্যাটেলাইটগুলোর জন্যও কক্ষপথে রয়েছে বিশেষ কবরস্থান। একে বলা হয়ে ‘গ্রেভইয়ার্ড অরবিট’। পৃথিবী থেকে প্রায় ২২,৪০০ মাইল উপরে অবস্থিত এই কবরস্থান। শেষ কার্যকরী স্যাটেলাইটের অবস্থান থেকেও যা প্রায় ২০০ মাইল দূরে। ফলে এই স্থানে নষ্ট স্যাটেলাইটকে পাঠিয়ে দিলে তা নিয়ে আর বাড়তি চিন্তা করতে হয় না।
তবে অনেক স্যাটেলাইট এই স্থানে দীর্ঘদিন ধরে থাকে। কিছু স্যাটেলাইট মহাশূন্যে আরও দূরে চলে যায়। তবে ভবিষ্যতে নষ্ট স্যাটেলাইটের সংখ্যা আরও বেড়ে গেলে এই স্থানটিও পরিপূর্ণ হয়ে যেতে পারে আবর্জনায়। তখন মানুষকে নতুন করে ভাবতে হবে এই ব্যাপারে। এজন্য নতুন করে এই আবর্জনাকে আরও দূরে ঠেলে সরিয়ে দিতে দরকার হতে পারে নতুন কোন মহাশূন্যে আবর্জনা সরাবার যানবাহন! তবে আপাতত এই নিয়ে ভাবছেন না বিজ্ঞানীরা।
অর্থাৎ বর্তমানে মৃত স্যাটেলাইটগুলোর দুটি পরিণতি হয়। বায়ুমণ্ডলে পুড়ে ছাই হয়ে ধ্বংস হয়ে যাওয়া অথবা দূরের কোন কক্ষপথে বাকি সময় চুপচাপ ঘুরতে থাকা। মূলত স্যাটেলাইট কত দূরে রয়েছে সেটির উপর নির্ভর করেই তাদের পরিণতি নির্ধারিত হয়। তবে মহাশূন্যের এসব আবর্জনা মানুষের জন্য ভালো কিছু নয়। কাজেই এই বিষয়টি বিজ্ঞানীদের জন্য মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে উঠছে। এজন্য নতুন কোন সমাধান খোঁজা জরুরি হয়ে পড়েছে পৃথিবী থেকে দূরে অবস্থান করা স্যাটেলাইট ও আবর্জনার জন্য। নয়তো ভবিষ্যতে মহাশূন্যে ভ্রমণ করা অনিরাপদ হয়ে উঠতে পারে দ্রুতই।
- বাংলাটেক ফেসবুক গ্রুপে যোগ দিয়ে প্রযুক্তি বিষয়ক যেকোনো প্রশ্ন করুনঃ এখানে ক্লিক করুন।
- বাংলাটেক ফেসবুক পেইজ লাইক করে সাথে থাকুনঃ এই পেজ ভিজিট করুন।
- বাংলাটেক ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করতে এখানে ক্লিক করুন এবং দারুণ সব ভিডিও দেখুন।
- গুগল নিউজে বাংলাটেক সাইট ফলো করতে এখানে ক্লিক করুন তারপর ফলো করুন।
- বাংলাটেক সাইটে বিজ্ঞাপন দিতে চাইলে যোগাযোগ করুন এই লিংকে।
- প্রযুক্তির সব তথ্য জানতে ভিজিট করুন www.banglatech24.com সাইট।