বিভ্রান্তিগাঁথা

১। “আনন্দময়ী পান সাজিতেছিলেন, শশিমুখী তাঁহার পাশে বসিয়া সুপারি কাটিয়া স্তূপাকার করিতেছিল”, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত একটি উপন্যাসে গ্রামবাংলার ‘পান সংস্কৃতি’ এতটাই শৈল্পিকভাবে ফুটে উঠেছে।

কিন্তু কবিগুরু হয়ত জানতেন না, এই নিরীহ ‘পান’ও হয়ে উঠতে পারে চরম বিব্রতকর, যা আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি।

কাজিনের বিবাহোত্তর সংবর্ধনায় যাচ্ছিলাম। পথে ‘উন্নয়নরত’ রাস্তার ধুলোবালি আমার জুতোজোড়া একদম আপন করে নিল। ধূলিকণার বন্ধন থেকে মুক্তি পেতে অনেক খুঁজে একজন মুচির সন্ধান পেলাম। সে ভীষণ ব্যস্ত। তাকে বললাম, “ব্রাশ দিয়ে জুতোদুটো একটু মুছে দিতে পারবেন?”

তিনি এই সহজ কাজটি করার তেমন কোনো আগ্রহ দেখালেন না। অবস্থা বেশি সুবিধার না দেখে তাকে এজন্য ১০ টাকা অফার করলাম। মনে হল তিনি অফারটি পছন্দ করেছেন। কয়েক মিনিটেই কাজ সম্পন্ন হল।

ঠিক তখনই আবিষ্কার করলাম, এই অল্প সময়ে আমার শাদা শার্টে লাল লাল কীসের যেন একটা দাগ লেগে গেছে। পানের পিক ছিল সম্ভবত। অসহ্য রকমের বিরক্তি লাগল। শেষমেশ টিস্যু দিয়ে যতটা সম্ভব মুছে শীতের পোশাক পরে কবিগুরুর শৈল্পিক পানের রঙ্গলীলা আড়াল করলাম। শীতঋতুর প্রতি আমার তেমন কোনো দুর্বলতা ছিলনা, কিন্তু নেহায়েত ঠাণ্ডা আবহাওয়ার কারণে এইযাত্রা রক্ষা পেলাম। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত একজোড়া অভিজ্ঞতা সংগে করে রিসিপশন প্রোগ্রামে যোগ দিলাম।

প্রবাদে শুনেছি, ‘যার বিয়া তার খবর নাই, পাড়াপড়শির ঘুম নাই’। প্রথম দর্শনে কমিউনিটি সেন্টারকে আমরা মোটামুটি জনশূন্যই আবিষ্কার করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকসমাগম শুরু হল। আমাদের কাজিন তখনও পৌঁছেনি। বিভিন্ন বয়সের অতিথিরা আসছেন, তাঁদের সাথে কুশল বিনিময় করার জন্য কমপক্ষে দুজন লোক দরকার। যদিও এই কাজটি করার জন্য বরের নিজেরই প্রধান ভূমিকা থাকে, তবে যেহেতু সে এখনও পথিমধ্যে তাই আমাকেও রিসিপশনে যুক্ত হতে হল।

মানুষকে বিভ্রান্ত করার মাঝে কোনো গৌরব নেই, কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষ কিছুটা মজা পাওয়া যায়। আমাকে দেখে কেউ বিভ্রান্ত হোক তা আমি কখনোই চাইনা। আমার এই কাজিনের চেহারার সাথে আমার চেহারার কিছুটা মিল আছে- এমনটি অনেকেই বলে থাকেন, যারা বেশিরভাগই আমাকে প্রথমবার দেখেন। একবার এই ভাইয়ার এক খালা (অথবা মামী) আমাকে বলেই ফেললেন ‘কবে দেশে আসলে?’। সেদিন আমি বিনয়ের সাথে উনার বিভ্রান্তি দূর করে দিয়েছিলাম।

কিন্তু বৌভাতের অনুষ্ঠানে এসে বিভ্রান্তিসংকটের সমাধান করা কোনো কাজের কথা না। কিছুসংখ্যক অতিথি নাহয় কনফিউজড হলেনই, স্বয়ং কনে সঠিক উত্তরে টিক দিতে পারলেই হলো!

কমপক্ষে এক ডজন অতিথি আমার সাথে যেচে এসে হ্যান্ডশেক করলেন। কারও কারও চোখে কিছুটা কনফিউশনের ছায়া ছিল। যাঁরা আমাকে আমার কাজিন ভেবেছিলেন আমি শুধু তাঁদেরই ভুল ভাঙালাম এবং বসার আসন পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। একজন বলেছিলেন, “আমাকে চিনতে পেরেছ তো, আমি তোমার ‘অমুক’ আংকেল, এলিফ্যান্ট রোড বাসা”। আমি তাঁকে ছোট্ট করে আমার নামটা বললাম। ভদ্রলোকের বিভ্রান্তি তাতেও কাটল বলে মনে হলনা। আমিও আর তাঁকে হতাশ করার চেষ্টা করলাম না। কৌশলে মোবাইলে ওনার একটা ছবি তুলে নিলাম (পরে চেনার জন্য), কিন্তু ছবিটা স্পষ্ট আসেনি।

একপর্যায়ে তিনজন তরুণ নিজেদের মধ্যে কীসব আলোচনা করে আমাকে এসে জিজ্ঞেস করল, “ভাইয়া মাইন্ড করবেন না। আপনি বর, নাকি বরের ভাইব্রাদার?”

আমি কিঞ্চিৎ মজা নেয়ার উদ্দেশ্যে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, “আপনাদের কী মনে হয়?”। তারা বলল তারা দ্বিধাবিভক্ত। আমি জবাব দিলাম “বর আমার ভাইব্রাদার হয়”।

২। তরুণীর বয়স কতইবা হবে, ষোলো কিংবা সতেরো? কমিউনিটি সেন্টারের উৎসবমুখর পরিবেশ যেনো তাকে বরণ করে নিয়েছে। এত সুন্দরভাবে সাজগোজ করে এসেছে, তাতে হঠাত দেখলে মনে হতে পারে বিয়েটা তারই ছিল। কিন্তু বাল্যবিবাহ হয়ে যাবে বলে আপাতত পিছিয়ে দেয়া হয়েছে।

চাইলে এর একটা ছবি তুলে নেয়া যায়, তাতে কেউ কিছু মনে করবেনা। কারো ছবি তুলতে গেলে ভদ্রতাবশত অনুমতি নিতে হয়। শুধুমাত্র বিয়ের অনুষ্ঠানই হচ্ছে এই নিয়মের ব্যতিক্রম, বিশেষ করে শহরে। বিয়ে সংক্রান্ত যেকোনো প্রোগ্রামে অনুমতি ছাড়াই যেকারো ছবি তোলা যায়, অন্তত আমি এরকমই দেখে এসেছি। ভাগ্য ভালো হলে ক্যামেরার সামনে কেউ কেউ মুচকি হেসেও দিতে পারে।

এই বালিকা হাসছেনা। তাতে অবশ্য আমার কোনো সমস্যা নেই, কারণ আমি তার ছবি তুলতে যাচ্ছিনা। কিংবা পরিচিত হওয়ারও ইচ্ছা পোষণ করছিনা। নিতান্ত অপরিচিত কোনো মেয়ের দিকে কিছুক্ষণ পরপর তাকিয়ে দেখা ভদ্রসমাজ সমর্থন করেনা। মেয়েরা হচ্ছে মায়ের জাতি। তাদেরকে সম্মান করতে হয়।

কিন্তু একটা ব্যাপার মেনে নিতে কিছুটা খারাপই লাগছে। মেয়েটির হাতে কালো হাতলের কী যেনো একটা দেখা যাচ্ছে। পায়ে ব্যথা বা এজাতীয় কোনো সমস্যা থাকলে লোকজন সাপোর্ট হিসেবে কালো রঙের যে স্টিলের সরু লাঠি ব্যবহার করে সেরকম কিছু মনে হচ্ছে।

এই বয়সে এর ছুটোছুটি করার কথা। অনুষ্ঠান যদি কনেপক্ষের হত তাহলে সে দলবল নিয়ে গেটে পাত্রপক্ষকে আটকে গেটমানি দাবি করত। টিভিতে বিকাশের বিজ্ঞাপনে দেখেছি (যতদূর মনে পড়ে), একদল তরুণী বরের সামনে গেট আটকে ৩ হাজার টাকা দাবি করে বলে “তিন হাজার টাকা না দিলে গেট ছাড়বনা”। কিন্তু এখানকার পরিস্থিতি ভিন্ন। রাজধানীতে তো আর ৩ হাজার টাকা গেটমানি হতে পারেনা। কম করে হলেও ১০ হাজার টাকা চাইতে হত!

এতসব হিসেব ফেলে মেয়েটি চেয়ারেই বসে আছে। আমার চেয়ার থেকে এক সারি সামনে হাতের বামদিকে। কমিউনিটি সেন্টারের ভীর অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। প্রোগ্রাম জমে উঠছে। জেন্টল ভলিউমে বাংলা-হিন্দি মিক্সড প্লেলিস্টের গান ভেসে আসছে। ঘূর্ণায়মান ফেস্টিভ লাইট জ্বলছে। পুরো জায়গাটি প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠেছে। মেয়েটি এখনও বসে আছে। তার হয়ত ক্র‍্যাচে ভর দিয়ে হাঁটতে ভালো লাগছেনা। ব্যাপারটি অনুধাবন করলে খারাপ লাগারই কথা।

কিন্তু আমার অনুমানকে সে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ভুল প্রমাণ করে দিল। তার হাতে যে কালো লাঠিটি দেখেছিলাম তা আসলে কোনো সাধারণ লাঠি নয়, সেটি ছিল এ যুগের ক্রেজ “সেলফি স্টিক”। সে এক হাতে স্টিকের হাতল ধরে অন্য হাত দিয়ে টেনে সেলফি স্টিকের দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে নিল। এরপর তার মোবাইলকে সেলফি স্টিকের সাথে লাগিয়ে বিভিন্ন মুখভঙ্গি করে একের পর এক সেলফি তুলতে লাগল। বিচিত্র সেসব ভঙ্গি, বিচিত্র এই দুনিয়া! শুধু দেখছি আর অভিজ্ঞতা নিচ্ছি :)

📌 পোস্টটি শেয়ার করুন! 🔥

সর্বশেষ প্রযুক্তি বিষয়ক তথ্য সরাসরি আপনার ইমেইলে পেতে ফ্রি সাবস্ক্রাইব করুন!

Join 8,549 other subscribers

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *