ক্যাশবিহীন লেনদেনের এই যুগে ডেবিট কার্ড এবং ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলেছে। এসব কার্ড ব্যবহার করে মাত্র একটি সোয়াইপ এর মাধ্যম্যেই আপনি বিভিন্ন দোকানে কেনাকাটার মূল্য পরিশোধ করতে পারবেন। হাতে টাকা না থাকলে সহজেই যেকোনো সময় নগদ টাকা বা ক্যাশ পেতে পারেন। আপাতদৃষ্টিতে ডেবিট কার্ড এবং ক্রেডিট কার্ড একই মনে হলেও এদের মধ্যে বড় ধরনের কিছু পার্থক্য রয়েছে। চলুন জেনে নিই ডেবিট কার্ড এবং ক্রেডিট কার্ড এর মধ্যে পার্থক্যসমূহ, যাতে আমরা ক্ষেত্রবিশেষে সঠিক কার্ডটি ব্যবহার করতে পারি।
ডেবিট এবং ক্রেডিট
ডেবিট এবং ক্রেডিট হচ্ছে হিসাববিজ্ঞানে বহুল ব্যবহৃত দুটি শব্দ। খুব সংক্ষেপে ব্যাংকের দিক থেকে চিন্তা করলে, কোনো গ্রাহকের একাউন্টে বিদ্যমান টাকা যদি গ্রাহক তুলে নেন বা খরচ করেন, তাহলে ব্যাংক সেটাকে ডেবিট হিসেবে গণ্য করে। আর কোনো গ্রাহক যদি ব্যাংক থেকে ঋণ নেন, তাহলে সেটা ঐ গ্রাহকের নামে ব্যাংকের ডকুমেন্টে ক্রেডিট তালিকাভুক্ত হয়।
ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে গ্রাহক তার বিদ্যমান অর্থ খরচ করেন। অন্যদিকে, ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে গ্রাহক তার ক্রেডিট লাইন থেকে ঋণ নেন/খরচ করেন, যা পরে পরিশোধ করত হয়। অ্যাকাউন্টিং বা হিসাববিজ্ঞানের ডেবিট-ক্রেডিটের সাথে এর সরাসরি যোগসূত্র আপাতত না খুঁজে আমরা চলুন মূল আলোচনায় ফিরে যাই।
ডেবিট এবং ক্রেডিট কার্ড পরিচিতি
ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড দেখতে একই রকম। পার্থক্য হল এদের হিসাবনিকাশ ও নীতিমালায়। এগুলো মূলত পকেট সাইজের প্লাস্টিকের কার্ড হয়ে থাকে। পূর্বে চৌম্বকীয় স্ট্রিপযুক্ত কার্ড প্রদান করা হত, যেগুলোর পেছনের দিকে কালো একটি আয়তাকার স্থানে চৌম্বক ক্ষেত্র যুক্ত থাকত।
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে, বাংলাদেশে ব্যাংকগুলির জন্য চিপ এবং পিন ভিত্তিক কার্ড প্রদান বাধ্যতামূলক করা হয়। ভিতরে সুরক্ষা চিপযুক্ত কার্ডগুলিকে ইএমভি কার্ডও বলা হয়। এই কার্ডগুলি এনক্রিপটেড এবং পূর্বের কালো স্ট্রিপযুক্ত কার্ডের তুলনায় অধিক সুরক্ষাযুক্ত।
সাধারণত একটি ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডের সামনের অংশে ১৬ সংখ্যার একটি গোপনীয় কার্ড নম্বর, মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ এবং ইস্যুয়ার/পার্টনার প্রতিষ্ঠানের লোগো (যেমনঃ সিটি ব্যাংক, ভিসা, মাস্টারকার্ড ইত্যাদি) থাকে। কার্ডের অপর পাশে সিভিভি (আরেকটি গোপনীয় নম্বর), কার্ড-ধারকের স্বাক্ষর এবং কাস্টমার সার্ভিস এর ফোন নাম্বার দেয়া থাকে। যদিও অ্যামেরিকান এক্সপ্রেস ক্রেডিট কার্ডের সিভিভি নম্বর কার্ডের সামনের দিকেই দেয়া থাকে।
ডেবিট কার্ড কী?
সেভিংস (সঞ্চয়ী) কিংবা কারেন্ট (চলতি) অ্যাকাউন্ট এর গ্রাহকদের ব্যাংক থেকে ডেবিট কার্ড প্রদান করা হয়। এছাড়াও কর্পোরেট ব্যক্তিত্বদেরও ডেবিট কার্ড প্রদান করা হয়। এই কার্ডগুলি গ্রাহকের অ্যাকাউন্টের সাথে যুক্ত থাকে।
যদি আপনার অ্যাকাউন্টে পর্যাপ্ত ব্যালেন্স থাকে তাহলে ডেবিট কার্ড ব্যবহার করে এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলতে পারবেন, অনলাইন এবং অফলাইনে কেনাকাটা করতে পারবেন এবং আপনার অ্যাকাউন্ট থেকে অন্য কারও অ্যাকাউন্টে অর্থ স্থানান্তরও করতে পারবেন। বিভিন্ন ধরনের সেবা পেতে কিংবা পণ্য ক্রয় করতে ডেবিট কার্ড ব্যবহার করা যায়, এক্ষেত্রে আপনার একাউন্ট থেকে টাকা কেটে নেয়া হবে।
ক্রেডিট কার্ড কী?
ক্রেডিট কার্ড হল ডেবিট কার্ডের মতই পকেট সাইজের একটি (সাধারণত) প্লাস্টিকের কার্ড। বর্তমানে ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি চিপ-ভিত্তিক ক্রেডিট কার্ড প্রদান করে। ক্রেডিট কার্ডধারীর নাম, ক্রেডিট কার্ড নম্বর এবং মেয়াদ শেষ হওয়ার তারিখ ক্রেডিট কার্ড এর সম্মুখে দেয়া থাকে। সিভিভি, ক্রেডিট কার্ডধারীর স্বাক্ষর এবং কাস্টমার কেয়ার কেন্দ্রের বিবরণ (সাধারণত) অন্যদিকে দেয়া থাকে।
আগেই বলেছি, ক্রেডিট কার্ড এবং ডেবিট কার্ডের মধ্যে মূল পার্থক্য হল হিসাবনিকাশ ও অর্থ প্রদানের পদ্ধতিতে। যখন আপনি কোনো অর্থ প্রদানের জন্য ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন, তখন আপনার সেভিংস/কারেন্ট অ্যাকাউন্ট থেকে এই পরিমাণটি কেটে নেওয়া হয় না।
ডেবিট কার্ড এবং ক্রেডিট কার্ড এর মধ্যে পার্থক্য
কার্ড প্রদানকারী
ডেবিট কার্ড আপনার সেভিংস অ্যাকাউন্ট কিংবা কারেন্ট অ্যাকাউন্টের সাথে সম্পর্কযুক্ত। এটি মুলত ব্যাংক থেকে প্রদান করা হয়ে থাকে যেখানে আপনার উল্লেখ্য কোনো অ্যাকাউন্ট রয়েছে। অপরদিকে, আপনি নির্দিষ্ট কোনো ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট না খুলেও ঐ ব্যাংক (কিংবা আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান) থেকে ক্রেডিট কার্ড পেতে পারেন।
ফান্ড বা অর্থের উৎস
ক্রেডিট কার্ড এবং ডেবিট কার্ডের মধ্যে প্রাথমিক পার্থক্য হল ফান্ড বা অর্থের উৎসে। ডেবিট কার্ড দিয়ে লেনদেনের সময় আপনার চলতি বা সঞ্চয়ী ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যবহার করা হয়। আপনার অ্যাকাউন্ট থেকে ঐ পরিমাণ অর্থ তাৎক্ষণিক বিয়োগ করা হয়।
যখন আপনি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন, তখন ক্রেডিট কার্ড প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান সাময়িকভাবে সেই অর্থ প্রদান করে। ক্রেডিট কার্ড গ্রাহককে পরবর্তী বিল দেয়ার তারিখের মধ্যে ক্রেডিট কার্ড প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানকে অর্থ ফেরত দিতে হয়।
ফান্ড ব্যবহারের অনুমতি
একটি ডেবিট কার্ড আপনাকে কেবল আপনার চলতি বা সেভিংস অ্যাকাউন্টে সংরক্ষিত পরিমাণের অর্থ ব্যবহারের অনুমতি দেয়। আপনার অ্যাকাউন্টে ১০ হাজার টাকা থাকলে আপনি কেবল সেই ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থ ব্যবহার করতে পারবেন।
অন্যদিকে ক্রেডিট কার্ডধারীরা পূর্ব-অনুমোদিত ক্রেডিট সীমা পর্যন্ত ফান্ড ব্যবহার করতে পারে। সাধারণত, উচ্চ ক্রেডিট স্কোরযুক্ত অ্যাকাউন্ট কিংবা ব্যাংকের সাথে ব্যবহারকারীর কর্পোরেট অ্যাকাউন্ট থাকলে সেক্ষেত্রে তাদের একটি উচ্চ পরিমাণের অর্থ ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়।
👉 আপওয়ার্ক এর মাধ্যমে অনলাইনে আয় শুরু করবেন যেভাবে (জানতে এখানে ক্লিক করুন)
সুদ
ডেবিট কার্ডের ক্ষেত্রে ফান্ড থেকে রিয়েল-টাইমে অর্থ স্থানান্তর করা হয়, কোনো সুদ যুক্ত না করেই। তবে কোনো কোনো ব্যাংক গ্রাহকের একাউন্টে জমা থাকা টাকার ওপর গ্রাহককে সুদ দিতে পারে যা মূল ব্যালেন্সে যোগ হয়। অন্যদিকে, ক্রেডিট কার্ডের বিল পরিশোধে বিলম্ব হলে সুদ প্রদান করতে হয়। তবে অব্যবহৃত ক্রেডিট লিমিটের ওপর কোনো বাড়তি অর্থ গ্রাহক পান না।
পরিশোধ
যেহেতু ডেবিট কার্ডে ঋণ হিসেবে অর্থ নেওয়ার দরকার হয়না, তাই সুদ হিসেবে বাড়তি কোনো অর্থ পরিশোধের প্রয়োজন হয়না। তবে ক্রেডিট কার্ডধারীদের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ব্যবহৃত টাকা না দিলে বাড়তি অর্থ পরিশোধ করতে হয়।
ফি ও চার্জ
আপনার ডেবিট কার্ড ব্যবহার চালিয়ে যেতে আপনাকে রেজিষ্ট্রেশন ফি এবং প্রসেসিং ফি সহ একটি বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণ ফি দিতে হবে। আপনার ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার চালিয়ে যাওয়ার জন্যও আপনাকে এ ধরনের ফি প্রদান করতে হবে, তবে আপনাকে দেরীতে প্রদানের ফি, প্রিপেইমেন্ট জরিমানা এবং ফোরক্লোজার চার্জও দিতে হতে পারে। এটা ব্যাংক/ইস্যুয়ার প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করে।
মাসিক স্টেটমেন্ট
কোনো ডেবিট কার্ডের জন্য সাধারণত কোনও মাসিক স্টেটমেন্ট দেয়া হয় না। আপনি আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের স্টেটমেন্টের মাধ্যমে আপনার ডেবিট কার্ডের লেনদেন দেখতে পারেন। ক্রেডিট কার্ডের জন্য একটি মাসিক স্টেটমেন্ট প্রদান করা হয়। লেনদেনের পরিমাণ ক্রেডিটে সরবরাহ হওয়ায় এটি প্রয়োজনীয়।
সুবিধা
সাধারণত ডেবিট কার্ডে উল্লেখযোগ্য কোনো সুযোগ-সুবিধা থাকেনা। কিন্তু ক্রেডিট কার্ড অনেক ধরনের সুবিধা প্রদান করে। ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে আপনি ক্যাশ ব্যাক, ডিসকাউন্ট, পার্টনার প্রিভিলেজ, এবং রিওয়ার্ড পয়েন্ট অর্জনের মত সুবিধা উপভোগ করতে পারবেন। অবশ্য নির্দিষ্ট কিছু ডেবিট কার্ডে অনেক সময় ডিসকাউন্ট বা ক্যাশব্যাক অফার পাওয়া যায়, যদিও ক্রেডিট কার্ডের তুলনায় তা খুব বেশি হয়না।
👉 নতুন ক্রেডিট কার্ড নেয়ার পর যে কাজগুলো অবশ্যই করবেন তা জানতে এখানে ক্লিক করুন
ডেবিট এবং ক্রেডিট, উভয় ধরনের কার্ডেরই আলাদা আলাদা ক্ষেত্রে ব্যবহারের বিশেষ কিছু সুবিধা আছে। তাই ক্ষেত্রবিশেষ এদের ব্যবহারে নির্দিষ্ট সুবিধা পাওয়া যাবে।
কিস্তিতে কোনো পণ্য কেনার জন্য ক্রেডিট কার্ড সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। অনেক বিক্রেতাই বাড়তি কোনো অর্থ না নিয়েই সহজ কিস্তি সুবিধা দিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে ক্রেডিট কার্ড সুবিধাজনক।
উপসংহার
মূল কথা হচ্ছে, ডেবিট কার্ড অনেকটা প্রিপেইড মোবাইলের মত। আপনার অ্যাকাউন্টে যতক্ষণ টাকা থাকবে, আপনি ততক্ষণ এটা দিয়ে লেনদেন করতে পারবেন। অপরদিকে, ক্রেডিট কার্ড হচ্ছে পোস্ট-পেইড। এটা হল ব্যাংক থেকে কার্ডের মাধ্যমে লোন নেয়া, যার অর্থ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফেরত না দিলে সুদ এবং এমনকি জরিমানা সহ ফেরত দিতে হয়। অন্যথায় আইনী ব্যবস্থার সম্মুখীন হতে হয়। আশা করি ডেবিট কার্ড এবং ক্রেডিট কার্ড এর মধ্যে পার্থক্য এখন আপনার নিকট স্পষ্ট হয়েছে।
আপনি কোন ধরনের কার্ড পছন্দ করেন? ডেবিট নাকি ক্রেডিট? কমেন্টে জানানোর অনুরোধ রইল।
- বাংলাটেক ফেসবুক গ্রুপে যোগ দিয়ে প্রযুক্তি বিষয়ক যেকোনো প্রশ্ন করুনঃ এখানে ক্লিক করুন।
- বাংলাটেক ফেসবুক পেইজ লাইক করে সাথে থাকুনঃ এই পেজ ভিজিট করুন।
- বাংলাটেক ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করতে এখানে ক্লিক করুন এবং দারুণ সব ভিডিও দেখুন।
- গুগল নিউজে বাংলাটেক সাইট ফলো করতে এখানে ক্লিক করুন তারপর ফলো করুন।
- বাংলাটেক সাইটে বিজ্ঞাপন দিতে চাইলে যোগাযোগ করুন এই লিংকে।
- প্রযুক্তির সব তথ্য জানতে ভিজিট করুন www.banglatech24.com সাইট।