বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা হঠাৎ লক্ষ্য করলেন ওয়েবসাইট আর ভিজিট করা যাচ্ছেনা, অ্যাপ লোড হচ্ছে না, কিছু সোশ্যাল মিডিয়ার টাইমলাইন রিফ্রেশ হচ্ছে না। কারো লগইন ব্যর্থ, কারো ভিডিও স্ট্রিমিং বন্ধ, আবার কারো অনলাইন পেমেন্ট আটকে গেছে অচেনা কারণে। প্রথমদিকে অনেকে ভেবেছিলেন হয়তো তাদের ইন্টারনেট স্লো, কিংবা নির্দিষ্ট কোনো সাইটে সমস্যা। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে গেল, এটা কোনো বিচ্ছিন্ন সমস্যা নয়, সম্পূর্ণ বৈশ্বিক!
জনপ্রিয় ওয়েব ইনফ্রাস্ট্রাকচার কোম্পানি ক্লাউডফ্লেয়ার (Cloudflare) আকস্মিকভাবে ডাউন হয়ে পড়ায় অসংখ্য ওয়েবসাইট এবং অ্যাপ একইসঙ্গে অকার্যকর হয়ে যায়। ক্লাউডফ্লেয়ার ডাউন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবচেয়ে বেশি নজর কাড়ে X (টুইটার)-এ লগইন ও রিফ্রেশ সমস্যা। অনেকেই ভেবেছিলেন প্ল্যাটফর্মটি নিজেই ডাউন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় এক্স-এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ নেটওয়ার্ক নির্ভর করে ক্লাউডফ্লেয়ারের ওপর, আর সেই সংযোগ ভেঙে পড়ায় ব্যবহারকারীরা কিছুই করতে পারছিলেন না।
মানুষের একটা মজার অভ্যাস হলো, অনলাইন কোনো সেবা বা ওয়েবসাইট ডাউন হলেই তারা ছুটে যায় টুইটারে অভিযোগ করতে। যেন টুইটারই ছিল বৈশ্বিক “কমপ্লেইন সেন্টার”! কিন্তু এবার পরিস্থিতি পুরো উল্টো। ক্লাউডফ্লেয়ারের আউটেজ এতটাই বিস্তৃত ছিল যে অভিযোগ করার সেই চিরচেনা জায়গাটিও অর্থাৎ এক্স (টুইটার) নিজেই ডাউন হয়ে যায়। ফলে ব্যবহারকারীরা প্রথমবারের মতো এমন এক অবস্থার মুখোমুখি হলেন। ঝামেলা হলো, অভিযোগ করার স্থানও কাজ করছে না!
একই সময়ে ChatGPT, GitHub, Discord, DoorDash, AliExpress, এমনকি কিছু আন্তর্জাতিক ব্যাংক ও পেমেন্ট সার্ভিসও কাজ করছিলনা। ডাউনডিটেক্টরেও একসঙ্গে বহু প্ল্যাটফর্মে ত্রুটির রিপোর্ট আসতে শুরু করে, যা দ্রুতই ব্যাপক আলোচনা তৈরি করে। এমনকি ডাউনটাইম ডিটেক্ট করার কিছু সাইট নিজেরাই ডাউন হয়ে গিয়েছিল!
আসলে কী ঘটেছিল?
ক্লাউডফ্লেয়ার প্রথমে জানায় তারা সমস্যাটি “ইনভেস্টিগেটিং” পর্যায়ে রেখেছে। তবে প্রাথমিক ইঙ্গিত বলছে, এটি ছিল নেটওয়ার্ক ইস্যু। বিশেষত তাদের রাউটিং ও কনফিগারেশন স্তরে সমস্যা। বিশাল আকারের ওয়েবসাইট রাউটিং, DNS এবং CDN সার্ভিস পরিচালনার সময় একটি ভুল কনফিগারেশনও দ্রুত বৈশ্বিক ট্রাফিককে ব্যাহত করতে পারে। এ ধরনের সমস্যায় প্রথমে দেখা যায় ওয়েবপেজ লোড হতে দেরি হওয়া, তারপর আসে কানেকশন টাইম-আউট ত্রুটি, আর শেষ ধাপে পুরো সাইট অচল হয়ে দাঁড়ায়। এই আউটেজে ঠিক এমনটাই ঘটেছে।

🔥🔥 গুগল নিউজে বাংলাটেক সাইট ফলো করতে এখানে ক্লিক করুন তারপর ফলো করুন 🔥🔥
কেন ক্লাউডফ্লেয়ারের সমস্যা এত বড় প্রভাব ফেলে?
ইন্টারনেটের অধিকাংশ জনপ্রিয় সাইট দ্রুত লোড করতে এবং আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে ক্লাউডফ্লেয়ারের মত সার্ভিসের ওপর নির্ভর করে। এই কোম্পানি ওয়েবসাইটের CDN হিসেবে কাজ করে, DNS সার্ভিস দেয়, DDoS আক্রমণ প্রতিরোধ করে, এবং ট্রাফিককে নিরাপদ ও দ্রুত পৌঁছে দেয়।
যখন একজন ব্যবহারকারী কোনো ওয়েবসাইট ভিজিট করতে চান, তখন সে ওয়েবসাইটে আসলে ক্লাউডফ্লেয়ারের সার্ভারগুলো তার হয়ে দ্রুত সাড়া দেয়। তাই ক্লাউডফ্লেয়ারের কোনো একক সমস্যা মানে একসঙ্গে হাজারো সাইটের সমস্যা।
বাংলাদেশেও বহু সংবাদমাধ্যম, ই-কমার্স সাইট, পেমেন্ট গেটওয়ে এবং প্রাতিষ্ঠানিক সাইট ক্লাউডফ্লেয়ার ব্যবহার করে। ফলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা দেশের ভেতরেও বেশ কিছুক্ষণ সেবা পাচ্ছিলেন না।
এক্স (টুইটার) কেন সবচেয়ে বেশি আলোচনায়?
এক্স ব্যবহারকারীরা লক্ষ্য করেছেন টাইমলাইন লোড হচ্ছে না, নোটিফিকেশন আসছে না, রিপ্লাই দেখাচ্ছে না। এক্সে এত বেশি রিপোর্ট কেন?
কারণ হলো, প্ল্যাটফর্মটির টেকনিক্যাল স্ট্রাকচার ক্লাউডফ্লেয়ারের মতো তৃতীয় পক্ষ নেটওয়ার্ক সার্ভিসের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। এটি ব্যর্থ হওয়ায় তাদের API-ভিত্তিক ফিচারগুলো মুহূর্তে থমকে যায়। ডাউনডিটেক্টরে সবচেয়ে বেশি রিপোর্ট ছিল এক্স-কে ঘিরে—এটিই সোশ্যাল মিডিয়ায় আউটেজটির সবচেয়ে বেশি আলোচনার কারণ।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের ধারণা
প্রযুক্তি বিশ্লেষকদের মতে, এই ধরনের আউটেজ স্পষ্ট করে দেয় ইন্টারনেট কতটা কেন্দ্রীয় কিছু প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ক্লাউডফ্লেয়ার, অ্যামাজন AWS, এবং এ ধরনের অন্যান্য ক্লাউড সেবাদাতা কোম্পানি, এদের মধ্যে কেউ সমস্যায় পড়লে তার ঢেউ পুরো ইন্টারনেট জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইন্টারনেটের জন্য একাধিক স্তরের ব্যাকআপ নেটওয়ার্ক, মাল্টি-CDN সিস্টেম এবং ডিভাইডেড রাউটিং ব্যবস্থার প্রয়োজন আরও বেশি। না হলে ভবিষ্যতে আরও বড় আকারের আউটেজ দেখা যেতে পারে।
👉 ইন্টারনেট ছাড়াই চলবে নতুন মেসেজিং অ্যাপ ‘বিটচ্যাট’
ব্যবহারকারীরা কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন?
অনেক ব্যবহারকারী জানিয়েছেন তারা কোনো ওয়েবসাইট লোড করতে পারছিলেন না। কেউ কেউ ব্যাংকের অ্যাপ খুলতে গিয়েও সমস্যায় পড়েছেন। আবার অনেকে ভিডিও স্ট্রিমিং বা গেমিং সার্ভারে যুক্ত হতে পারেননি।
কিছুক্ষেত্রে VPN ব্যবহার করে সাময়িকভাবে সমস্যা সমাধান হয়েছে, কারণ VPN কখনো কখনো বিকল্প রাউটিং ব্যবহার করে যা হয়ত ক্লাউডফ্লেয়ারের সমস্যা পাশ কাটাতে পারে। তবে বেশিরভাগ ব্যবহারকারীর ক্ষেত্রে এতে কোনো উল্লেখযোগ্য লাভ হয়নি।
ক্লাউডফ্লেয়ারের দ্রুত প্রতিক্রিয়া
ক্লাউডফ্লেয়ার সাধারণত যেকোনো বড় সমস্যার পর দ্রুত তাদের স্ট্যাটাস পেজে আপডেট দেয় এবং সমাধান প্রক্রিয়া শুরু করে। এই আউটেজেও তারা দ্রুত রাউটিং সংশোধন করেছে এবং সেবাসমূহকে ধীরে ধীরে সচল করেছে।
সমস্যা সমাধানের পর তারা সাধারণত “Incident Report” প্রকাশ করে যেখানে বিস্তারিত জানানো হয় কোন পরিবর্তন সমস্যার মূল ছিল। এই রিপোর্টগুলো সাধারণত ডেভেলপার এবং ওয়েবমাস্টারদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এগুলো থেকে ভবিষ্যৎ সতর্কতার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
বাংলাদেশে এর প্রভাব কতটা ছিল?
বাংলাদেশে অনলাইন নিউজ পোর্টাল, ই-কমার্স, পেমেন্ট গেটওয়ে, ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাইটেও আউটেজ চলাকালীন সমস্যার রিপোর্ট এসেছে। কেউ কোনো ওয়েবসাইট খুলতে পারছিলেন না, কেউ আবার লগইন করতে গিয়ে ব্যর্থ হচ্ছিলেন।
অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করে জানিয়েছেন হঠাৎ করে তারা ভেবেছেন ইন্টারনেট পুরোপুরি ডাউন, পরে জানতে পারেন বিষয়টি ছিল বৈশ্বিক সমস্যা।
👉 ভিপিএন কীভাবে কাজ করে? ভিপিএন ব্যবহার করা কি নিরাপদ?
ভবিষ্যতের ঝুঁকি
বিশ্ব যেমন দ্রুত ডিজিটাল হচ্ছে, তেমনি বড় নেটওয়ার্ক কোম্পানিগুলোর ওপর নির্ভরশীলতাও বাড়ছে। কিন্তু এই নির্ভরশীলতার সঙ্গে ঝুঁকিও বাড়ছে। একটি কনফিগারেশন ভুল বা একটি রাউটিং সমস্যা ভবিষ্যতে আরও বড় আকারের বিপর্যয় তৈরি করতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অনেক প্রতিষ্ঠানই একক CDN বা একক DNS ব্যবস্থার ওপর পুরো ব্যবসা দাঁড় করিয়ে রেখেছে। এটি সুবিধাজনক হলেও ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের মতে, বৈশ্বিক ইন্টারনেটকে দীর্ঘমেয়াদে সচল রাখতে বিকেন্দ্রীভূত নেটওয়ার্ক কাঠামো প্রয়োজন।
ক্লাউডফ্লেয়ারের আউটেজ আবারও দেখিয়ে দিল, ইন্টারনেট যত বিশাল তার ভরসার জায়গাগুলো ততটাই সংকীর্ণ। একটি প্রতিষ্ঠানের সমস্যা কয়েক মিনিটের মধ্যে পুরো বিশ্বের সাইট, অ্যাপ, পেমেন্ট ও যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল করে দিতে পারে।
এক্স, গিটহাব, চ্যাটজিপিটি, ব্যাংকিং অ্যাপ এর সবই একই মূহূর্তে থেমে গেল। এটা আসলে আমাদের মনে করিয়ে দেয় ইন্টারনেটের আড়ালে থাকা প্রযুক্তিগুলো কতটা সংবেদনশীল। সমস্যাটি দ্রুত সমাধান হলেও, এটি কোটি কোটি ব্যবহারকারীকে এক বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়ে গেছে। একটি ছোট নেটওয়ার্ক সমস্যাই কেমন করে বড় আকারের বৈশ্বিক প্রভাব তৈরি করতে পারে, সেই অবিজ্ঞতা।
- বাংলাটেক ফেসবুক গ্রুপে যোগ দিয়ে প্রযুক্তি বিষয়ক যেকোনো প্রশ্ন করুনঃ এখানে ক্লিক করুন।
- বাংলাটেক ফেসবুক পেইজ লাইক করে সাথে থাকুনঃ এই পেজ ভিজিট করুন।
- বাংলাটেক ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করতে এখানে ক্লিক করুন এবং দারুণ সব ভিডিও দেখুন।
- গুগল নিউজে বাংলাটেক সাইট ফলো করতে এখানে ক্লিক করুন তারপর ফলো করুন।
- বাংলাটেক সাইটে বিজ্ঞাপন দিতে চাইলে যোগাযোগ করুন এই লিংকে।
- প্রযুক্তির সব তথ্য জানতে ভিজিট করুন www.banglatech24.com সাইট।

আমাদের যেকোনো প্রশ্ন করুন!