সম্পাদকের কথাঃ এই পোস্টটি আমাদের সাইটের নিয়মিত পাঠক এমএইচ সোহেল লিখে পাঠিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশে অবস্থিত বিশ্বের প্রথম সারির একটি ওয়েব অ্যাপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান জুমশেপার এ ডেভলপার হিসেবে কর্মরত আছেন।
আইফোন ৮ প্লাস এক সপ্তাহ ব্যবহার করার পর আমার ব্যক্তিগত মতামত নিচে তুলে ধরলাম। এই মতামত অন্য কারো সাথে নাও মিলতে পারে।
আমি সাধারণত উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিব, যেমন- ডিজাইন এবং বিল্ড কোয়ালিটি, হার্ডওয়্যার পারফরম্যান্স, ব্যাটারি লাইফ, ক্যামেরা, ডিসপ্লে, সাউন্ড এবং আরও কিছু খুঁটিনাটি বৈশিষ্ট্য। চলুন শুরু করি।
আইফোন ৮ প্লাস ডিজাইন
আপনি যদি আইফোনের নিয়মিত ব্যবহারকারী হন তবে হয়ত লক্ষ্য করবেন, আইফোন ৬, ৬এস, ৭, ৭ প্লাস এর ডিজাইনের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। এরই ধারাবাহিকতায় অ্যাপল একই ডিজাইনের আইফোন এইট প্লাস নিয়ে এলো। আপনি যদি ডিজাইনে একটা বড় ধরনের পরিবর্তন চান, তাহলে এটার ডিজাইন আপনাকে হতাশ করবে, তবে একটা ক্লাসিক ডিজাইন হিসেবে আইফোন ৮+ এর ডিজাইনটা আমার খুবই পছন্দের। আরেকটা বিষয় হল, আইফোন সেভেন প্লাস এবং এইট প্লাস হুবহু একই ডিজাইনের, কিন্তু সাইজে সামান্য একটু পরিবর্তন আছে। নিচে আইফোন সেভেন প্লাস এবং এইট প্লাসের সাইজ দেয়া হল।
- আইফোন সেভেন প্লাসঃ দৈর্ঘ্য ১৫৮.২ মিঃমিঃ, প্রস্থ ৭৭.৯ মিঃমিঃ, পুরুত্ব ৭.৩ মিঃমিঃ, ওজন ১৮৮ গ্রাম।
- আইফোন এইট প্লাসঃ দৈর্ঘ্য ১৫৮.৪ মিঃমিঃ, প্রস্থ ৭৮.১ মিঃমিঃ, পুরুত্ব ৭.৫ মিঃমিঃ, ওজন ২০২ গ্রাম।
ডিসপ্লে
আইফোন এইট প্লাসের ডিসপ্লে আইফোন সেভেন প্লাসের মতই এলসিডি ৫.৫ ইঞ্চি এবং ১০৮০ বাই ১৯২০ পিক্সেলের। তবে আইফোন এইট প্লাসে নতুন যোগ হয়েছে ট্রু-টোন প্রযুক্তি, যেটা আপনার পারিপার্শ্বিক আলোর উপর ভিত্তি করে ডিসপ্লের আলো পরিবর্তন করবে। এটা দারুণ এক ফিচার যা ভালো লেগেছে।
বিল্ড কোয়ালিটি
বিশ্বের প্রথম সারির ফোন হিসেবে আইফোনের বিল্ড কোয়ালিটি নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই, তবুও লেখার স্বার্থে বিল্ড কোয়ালিটি নিয়ে বলতেই হয়। আইফোন আইফোন এইট প্লাসের ফ্রন্ট এবং ব্যাক- দুই পাশেই গ্লাসের ব্যবহার হয়েছে, এবং এর কাঠামো তৈরী এ্যালুমিনিয়াম দিয়ে। উভয় পাশে গ্লাস ব্যবহারের কারণে দেখতে আরো আকর্ষণীয় লাগে। ব্যক্তিগতভাবে এটা আমার খুবই ভালো লেগেছে। আরো একটি ভালো খবর হচ্ছে যে, দুই পাশে গ্লাস ব্যবহার করার কারণে পিছনে কোন ধরনের স্ক্র্যাচ অথবা ফাঙ্গাস পড়ার ভয় নেই। আইফোন ব্যবহারকারীদের কাছে ফাঙ্গাস একটি আতংকের নাম। আইফোন এইটে/এইট+ এ এই আতঙ্ক অনেকটাই থাকছে না।
কিন্তু কথায় আছে বেশি সুখ কপালে সয় না; আইফোন ৮ প্লাসে উভয় পাশে গ্লাস ব্যবহারের কারণে হাত থেকে শক্ত কোন জায়গাতে পড়লেই সামনের অথবা পেছনের গ্লাস ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি। সেক্ষেত্রে সার্ভিসিংয়ের জন্য আবার মোটা অংকের টাকা গুণতে হবে। আরও ভয়ংকর কথা হচ্ছে, অ্যাপলের ভাষ্যমতে ফ্রন্ট গ্লাসের চেয়ে ব্যাক গ্লাস রিপেয়ার করতে বেশি টাকা খরচ হবে (কমপক্ষে ৯৯ ডলার)! ভাবুনতো একবার, ৭৩ হাজার টাকা দিয়ে একটা ফোন কিনে এই দশা হলে কেমন লাগবে? এ যেন মধুর সমস্যা। তাই শক্তপোক্ত ভালো ব্র্যান্ডের একটা কভার কিনে নেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
হার্ডওয়্যার পারফরম্যান্স
আইফোন এইট প্লাসে ৩জিবি র্যামের সাথে এ১১ বায়োনিক চিপসেট ব্যবহৃত হয়েছে যেটা আইফোনে এপর্যন্ত সবচেয়ে দ্রুতগতির চিপ। এই চিপে ৬টা কোর আছে যার মধ্যে ৪টা কোর (এ১০ ফিউশন চিপ যেটা আইফোন ৭ এবং ৭ প্লাসে ব্যাবহার করা হয়েছে), সেটা থেকে ৭০ পার্সেন্ট এবং আরো ২টা কোর ২৫ পার্সেন্ট বেশি গতি সম্পন্ন। এ১১ বায়োনিক চিপ আসলে কতটা দ্রুত কাজ করে সেটা আমরা নিচে গিকবেঞ্চের একটা তুলনামূলক তথ্যের মাধ্যমে জানতে পারব। (যত বেশি স্কোর, তত বেশি স্পিড। ক্রেডিটঃ টম’স গাইড)
চার্টে দেখা যাচ্ছে, আইফোন এইট প্লাসের মাল্টিকোরের স্কোর হচ্ছে ১০,৪৭২। এই স্কোর স্যামসাং গ্যালাক্সি নোট ৮, ওয়ানপ্লাস ফাইভ, অন্য সব ফ্লাগশিপ ফোনের চেয়ে অনেক বেশি। এবং দেখা যাচ্ছে, এই স্কোর আমার ম্যাকবুক প্রো এর চিপের চাইতেও অনেক বেশি গতি সম্পন্ন। আমি আসলেই জানিনা এত বেশি গতি দিয়ে একটা স্মার্টফোন করবেটা কী!
ক্যামেরা
আইফোন এইট প্লাসের পেছনে ১২ মেগাপিক্সেলের ডাবল ক্যামেরা লেন্স এবং সামনে ৭ মেগাপিক্সেলের সেলফি ক্যমেরা। আইফোন এইট প্লাসে আইফোন সেভেন প্লাসের থেকে উন্নতমানের ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়েছে। উন্নত বলা হয়েছে কারণ এতে আছে বড়, দ্রুত গতির সেন্সর এবং অত্যাধুনিক ইমেজ প্রসেসিং পাওয়ার।
পেছনের ক্যামেরা দিয়ে আপনি পোট্রেট মুডে ছবি তুলতে পারবেন যেটা একই সাথে ব্যাকগ্রাউন্ড অস্পস্ট এবং মুখের ছবি ঝকঝকে ও প্রাণবন্ত করে ফুটিয়ে তুলবে। এখানে একটি স্যাম্পল ইমেজ দেয়া হল।
আইফোন এইট প্লাসের ক্যামেরায় নতুন লাইটিং ইফেক্ট যোগ করা হয়েছে, যেমন স্টুডিও লাইট, স্টেইজ লাইট প্রভৃতি, যেগুলো দিয়ে আপনি নিজেই চমৎকার ছবি তুলতে পারবেন। এটা আপনাকে ছবি তোলার অসাধারণ অভিজ্ঞতার সাথে পরিচয় করিয়ে দিবে।
ফোনটির অপটিক্যাল ইমেজ জুম ফিচার দিয়ে আপনি দশ গুণ বেশি দূরের ছবি তুলতে পারবেন এবং ছবির মানও যথেষ্ট ভালো। আরো আছে স্লো-সিঙ্ক ফ্লাশ, যেটা ছবি তোলার সময় বেশি সময় নিয়ে অবজেক্টে ফ্লাশ ফেলে, আর তাতে আরো ক্লিয়ার ছবি পাওয়া যায়।
আইফোন ৮+ এর সেলফি ক্যামেরাও যথেষ্ট ভালো মানের ছবি তুলতে পারে, এবং এটা আপনার চেহারাতে কোনো ধরনের আটা ময়দা মাখায় না, একেবারে ন্যাচারাল ছবিই তোলে। (বাই দ্যা ওয়ে, হতাশ হলেন না তো? ???? )
কম আলোতে আইফোন বেশি ভালো ছবি তুলতে পারেনা, যথারীতি এখানে আমাকে হতাশ করল, তবে আগের মডেলগুলোর সাথে তুলনা করলে আইফোন এইট প্লাসে কম আলোর ছবি আগের চাইতে বেশ ভালো আসে। আশা করছি অ্যাপল এটা নিয়ে আরো বেশি কাজ করবে। আর আপনার যদি অন্ধকারে অথবা কম আলোতে ছবি তোলা অথবা ভিডিও করার অভ্যাস না থাকে, তাহলে তো কোন সমস্যাই নেই।
দিনের আলোতে আইফোন এইট প্লাস অবিশ্বাস্য রকমের ভালো ছবি তুলতে পারে, এ যেন ফোন দিয়ে ছবি তোলার এক নতুন অভিজ্ঞতা। ব্যক্তিগতভাবে ক্যামেরার পারফরম্যান্স এ আমি খুবই খুশী।
ভিডিও
আইফোন এইট প্লাসের ভিডিও কোয়ালিটিও দারুণ, এতে নতুন যুক্ত হয়েছে ৬০ এফপিএস (ফ্রেম পার সেকেন্ড)’এ ৪কে ভিডিও। যার মানে হচ্ছে সাধারণ এইচডি ক্যামেরার ফোন দিয়ে তোলা ভিডিওর কোয়ালিটি থেকে আইফোন এইট প্লাসে তোলা ভিডিওর কোয়ালিটি অনেক বেশি হবে। আরো বেশি ভিডিও দেখার জন্য ইউটিউবে কিছু ভিডিও দেখতে পারেন। একটা ভিডিওর নমুনা নিচে দেওয়া হল।
জিপিইউ
আইফোন এইট প্লাসের জিপিইউ ডিজাইন করেছে অ্যাপল নিজে, তাদের তথ্য মতে এটা আগের জিপিইউর থেকে ৩০% বেশি গতি সম্পন্ন, এতে ৩ কোর ব্যবহার করা হয়েছে। আর তাই গ্রাফিক্স প্রসেসিং হচ্ছে আগের চেয়ে আরো দ্রুত এবং হাই ডেফিনেশন গেইম খেলা যায় আরো স্মুথলি।
সাউন্ড
আইফোন এইট প্লাসে আছে স্টেরিও স্পিকার, যেটা আইফোন সেভেন থেকে ২৫% বেশি জোড়ালো শব্দ করতে পারে। শব্দ একদম নিখুঁত। বেইজও খুবই ভালো শব্দ দেয়। সাউন্ড ভালো হওয়ার কারণে ভলিউম বেশি দিয়ে গান শুনতে আমার কাছে খুবই ভালো লাগে।
ব্যাটারি লাইফ
ব্যাটারি লাইফ নিয়ে আইফোন ব্যবহারকারীদের অভিযোগ বেশি শোনা যায়, যেটা অ্যাপল আইফোন সেভেনে ঘুচিয়েছে। আইফোন এইটের ২৬৯১ এমএএইচ এর শক্তিশালী ব্যাটারি আমাকে দিচ্ছে দীর্ঘক্ষণ ব্যাকআপ এবং কোনকরম চার্জের দুশ্চিন্তা ছাড়াই একটানা ব্যবহারের সুযোগ।
আমি এক চার্জে ফোনের প্রায় সবগুলো ফিচার অন রেখে (ওয়াইফাই, জিপিএস, অন্যান্য) ৯ ঘন্টার উপরে বেশ ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারি। এটার সর্বোচ্চ স্ট্যান্ডবাই টাইম ছিল ৬০ ঘন্টার মত, যেটা আরো বেশি হবে। মানে হচ্ছে আমি মিডিয়াম ব্যবহার করে ২ দিনের একটু বেশি ব্যাকআপ পাই, আর এটা আমার আগের আইফোন সেভেন প্লাস থেকেও বেশী, কারণ এ১১ বায়োনিক চিপ অন্য সব আইফোনের চিপ থেকে অনেক কম শক্তি খরচ করে। সুতরাং ব্যাটারি ব্যাকআপ নিয়ে আমি খুবই সন্তুষ্ট।
অন্যান্য
আইফোন এইট প্লাসের আরো যে ফিচারগুলো উল্লেখযোগ্য, তার মধ্যে আছেঃ
- ব্লুটুথ ৫ ভার্সন- মানে হচ্ছে আগের চেয়ে আরো বেশি রেঞ্জে এই ব্লুটুথ কাজ করবে।
- ওয়্যারলেস চার্জিং- কিউআই প্রযুক্তির চার্জার দিয়ে তার ছাড়াই এই ফোন চার্জের ব্যবস্থা আছে। ফোনের সাথে তারযুক্ত সাধারণ চার্জার দিয়ে দেয় অ্যাপল। ওয়্যারলেস চার্জার আলাদা কিনতে হয়, যার দাম ৫৯ ডলারের মত।
- ফাস্ট চার্জ সাপোর্টেড- এই সুবিধা উপভোগের জন্য অবশ্য একটা বাড়তি ফাস্ট চার্জার কিনতে হবে, তাহলে মাত্র ৩০ মিনিটে ৫০% চার্জ হয়ে যাবে। দারুন না?
- ওয়াটার এবং ডাস্ট রেসিসট্যান্ট- আইফোন এইট প্লাস আইপি৬৭ ওয়াটার এবং ডাস্ট রেসিসট্যান্ট সার্টিফায়েড। মানে হচ্ছে, এটা পানির ১ মিটার নিচে ৩০ মিনিট পর্যন্ত কোনো রকম ক্ষতি ছাড়াই থাকতে পারবে। যদিও এই ফিচারটি এখনো পরীক্ষা করে দেখিনি।
আরো পড়ুনঃ আইফোন ১০, নাকি আইফোন ৮? আপনার কোনটি কেনা উচিত?
এই হচ্ছে আমার আইফোন এইট প্লাসের উপর ছোট একটা রিভিউ, আপনার যদি একটা শাওমি অথবা ওয়ানপ্লাস ফোন থাকে, অথবা পুরাতন আইফোন মডেল থেকে আপগ্রেড করার ইচ্ছা আর বাজেট থাকে, তাহলে নির্দ্বিধায় আজই একটা আইফোন এইট প্লাস কিনে নিতে পারেন। আর আগের ফোনটি বিক্রি করে দিতে পারেন, অথবা কাউকে উপহার হিসেবে দিতে পারেন, সেও খুশি হবে একটা ফোন পেয়ে, আর আপনিও আনন্দিত হবেন একটা আইফোন এইট প্লাসের মালিক হয়ে ???? ।
- বাংলাটেক ফেসবুক গ্রুপে যোগ দিয়ে প্রযুক্তি বিষয়ক যেকোনো প্রশ্ন করুনঃ এখানে ক্লিক করুন।
- বাংলাটেক ফেসবুক পেইজ লাইক করে সাথে থাকুনঃ এই পেজ ভিজিট করুন।
- বাংলাটেক ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করতে এখানে ক্লিক করুন এবং দারুণ সব ভিডিও দেখুন।
- গুগল নিউজে বাংলাটেক সাইট ফলো করতে এখানে ক্লিক করুন তারপর ফলো করুন।
- বাংলাটেক সাইটে বিজ্ঞাপন দিতে চাইলে যোগাযোগ করুন এই লিংকে।
- প্রযুক্তির সব তথ্য জানতে ভিজিট করুন www.banglatech24.com সাইট।