অবচেতনঃ হুমায়ূন আহমেদের সাথে কথোপকথন

শীতের বিকেল, আমাদের বাড়ির উঠোনে প্রচুর লোক সমাগম। সেখানে স্বয়ং হুমায়ূন আহমেদ উপস্থিত। তাঁর সঙ্গে সরাসরি কথোপকথনের অনুষ্ঠান হচ্ছে। সচরাচর আমরা যেরকম টকশো দেখি, এই অনুষ্ঠানটি সেরকম না। লাইট-ক্যামেরা-একশন দেখছি না। এখানে কোনো টেবিল-চেয়ার নেই। চায়ের কাপও দেখা গেলনা। মঞ্চের এক কোণায় সোফা আছে যেটাতে একজন মানুষ বসলে আর জায়গা থাকবেনা। মূল মঞ্চ খুব একটা উঁচুও না। মঞ্চের সীমানা থেকে বাইরে দর্শক সারি পর্যন্ত কয়েক হাত জায়গায় খড়ের গালিচা বিছানো। এই খড় দেয়া অংশটুকু হচ্ছে “নো-এন্ট্রি জোন”, অর্থাৎ এই এরিয়ার মধ্যে কেউ প্রবেশ করতে পারবেনা।

হুমায়ূন আহমেদের সাথে শীতের বিকেলে এরকম ব্যতিক্রমী লাইভ অনুষ্ঠান দেখার লোভ সামলানো কঠিন। আমাদের উঠোনের সামনে ট্রাফিক জ্যাম লেগে গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সদস্যরা ভীষণ ব্যস্ত। এরই মধ্যে দেখলাম একটা ছেলে হঠাত হাটু গেঁড়ে বসে পড়ল। সে শার্টের মধ্য থেকে কী যেন বের করতে উদ্যত হল। কাছাকাছি সবাই আতংকগ্রস্ত হল, তারা ভাবল বোমা-টোমা মারছে নাকি এই তরুণ? কিন্তু না। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সে আসলে তার মোবাইল ফোন বের করল। কিন্তু ওরকম অঙ্গভঙ্গি কেন করল সেটা বুঝলাম না। অবশ্য, স্বপ্নের মধ্যে অনেক কিছুই ঘটে যার কোনো ব্যাখ্যা দাঁড় করানো কঠিন। সেই চেষ্টাও অনেক সময় করা হয়না।

যাইহোক, মূল অনুষ্ঠান শুরু হলো। উপস্থাপনা করছেন অভিনেতা জাহিদ হাসান। শুরুতেই জাহিদ হাসান বললেন “আজ আমরা এমন একজনকে মঞ্চে নিয়ে এসেছি যিনি আমাদের প্রাণ খুলে হাসিয়েছেন আবার কাঁদিয়েছেনও। তিনি কমেডিতেও সেরা, আবার ট্র‍্যাজেডিতেও। তিনি সেই মোশাররফ করিম।” জাহিদ হাসান হুমায়ূন আহমেদকে কিছুটা চমকে দিতে ইচ্ছে করেই স্যারের নিজের নামের পরিবর্তে মোশাররফ করিমের নাম উচ্চারণ করেছেন। হুমায়ূন আহমেদ কিছুটা হাসলেন, সেইসাথে মঞ্চের বাইরে যেতে উদ্যত হয়ে বললেন, “তাহলে আমি চলে যাই”। জাহিদ হাসান তাঁকে ফেরালেন, এবং বললেন “স্যার মজা করলাম। সব সময় তো আপনি সারপ্রাইজ দেন, আজকে আমি দিলাম”।

এই পর্যায়ে দর্শক সারি থেকে কারা যেন প্রশ্ন করছে। কী প্রশ্ন করছে সেটা শুনতে পাচ্ছিনা। এখানে কোনো লাউড স্পিকার নেই। এত বড় একটা প্রোগ্রামে লাউড স্পিকারের ব্যবস্থা করা হয়নি, ব্যাপারটা কেমন হলো? তখন অবশ্য এটা মনেও হয়নি। ঘুম থেকে ওঠার পর এখন মনে হচ্ছে।

এক সময় আমি সেই খড়ের নো-এন্ট্রি জোনের কাছে এসে অনুষ্ঠান দেখছি। এখনো কোনো প্রশ্ন করিনি। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, “এই যে লম্বা চুপচাপ ছেলেটা, কোনো প্রশ্ন করতে চাও?” আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি তিনি আমাকেই বলছেন কিনা। আমি শুধু দেখেই যাচ্ছি। হুমায়ূন আহমেদ আবারও বললেন “তোমাকেই বলছি, কিছু বলতে চাও আমাকে?”

আমি হচকিত হয়ে গেলাম। এতবড় একজন মানুষ আমাকে জিজ্ঞেস করছেন আমি তাঁকে কিছু বলতে চাই কিনা। কী বলব কিছু মাথায় আসছিল না। হঠাত বলে ফেললাম, “স্যার, আপনার লেখা আমার অনেক পছন্দ। বিশেষ করে হিমু সিরিজ।” তিনি হাসলেন। এরকম কথা শুনে শুনে তিনি অভ্যস্ত। আমি এক্সেপশনাল কিছু বলতে চাচ্ছি, কিন্তু মনে আসছেনা। এরকম অবস্থাকে বাংলা ব্যাকরণে ‘কিংবক্তব্যবিমূঢ়’ বলে অভিহিত করা যেতে পারে। আমি আবার বললাম “স্যার আপনার সৃষ্টিকর্ম আমার খুব ভালো লাগে, কিন্তু আপনার সাথে আমার কখনো দেখা হয়নি”। তিনি এবার আর হাসলেন না। আমি দ্রুত কথা বলে যাচ্ছি। কারণ এই সুযোগ বার বার আসেনা। আমি বললাম, “স্যার, হিমুকে নিয়ে সিনেমা হবে না?” হুমায়ূন আহমেদ “হ্যাঁ” বা “না” কিছুই বললেন না। আমিও এরকম কিছুই অনুমান করেছিলাম। আবার প্রশ্ন করলাম, “স্যার, নক্ষত্রের রাত সিনেমার কাহিনী সম্পর্কে কিছু বলবেন কি? এই নামে আপনার একটা নাটক আছে, আমি শুনেছি নাটকটির কাহিনীর সাথে সিনেমার কোনো মিল থাকবেনা।” হুমায়ূন আহমেদ বললেন “তা ঠিক, কিন্তু তুমি নক্ষত্রের রাত সিনেমা সম্পর্কে কীভাবে জানলে? এটার তো কেবলমাত্র চিত্রনাট্য লেখা হয়েছে। সিনেমা কবে হবে তা এখনও ভাবিনি।”

এই পর্যায়ে আমার সাবকনশাস মাইন্ড কাজ করল। মনে মনে বললাম “হুমায়ূন আহমেদ তো সেই ২০১২’তে পৃথিবী ছেড়ে গেছেন। এখন কি আমি তাঁকে বলব যে, স্যার আপনি এখন আর ফিজিক্যালি আমাদের মাঝে নেই। আপনার মৃত্যুর পর আপনার কৃষ্ণপক্ষ উপন্যাস নিয়ে সিনেমা হয়েছে। এখন ‘নক্ষত্রের রাত’ নামেও আরেকটি সিনেমা হতে যাচ্ছে। সেই সিনেমার কাহিনী সম্পর্কে আমার ধারণা নেই, তাই কৌতূহলবশত জানতে চাচ্ছি আরকি।”

পরক্ষণেই ভাবলাম, আমি যদি এখন স্যারকে বলি যে তিনি আসলে ‘আমাদের মাঝে নেই’, আমি মূলত এটা স্বপ্ন দেখছি, তাহলে তিনি হয়ত কষ্ট পাবেন। ব্যাপারটিকে হালকাভাবে দেখা হবে। আমার সাথে এত আন্তরিকভাবে কথা বলছেন, এখন বরং আমার উচিত হবে তাঁর সাথে কথা চালিয়ে যাওয়া।

অর্ধেক ঘুমন্ত-অর্ধেক জাগ্রত অবস্থায় একজন কিংবদন্তীর সাথে কথা বলছি, এর চেয়ে বিচিত্র কিছু হতে পারে বলে আমার জানা নেই। আমি জানি, হুমায়ূন আহমেদ পরকালে রয়েছেন, তার পরও অবচেতন মনে তাঁর কাছ থেকে নক্ষত্রের রাত এর গল্প শুনতে চাচ্ছি। হিমু-রূপাকে নিয়ে সিনেমা দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করছি। কেন করছি তা বুঝতে পারছি না। একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছি, যেন তিনি আমার সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে বসেছেন। স্বপ্নের মধ্যে কোনো কোনো সময় আমরা বুঝতে পারি যে এটা বাস্তব নয়, স্বপ্ন দেখছি। এই স্বপ্নেও তা বুঝে গিয়েছিলাম। কিন্তু সাবজেক্ট ম্যাটার যেখানে হুমায়ূন আহমেদের মত গল্পের যাদুকর, সেখানে সাবকনশাস মাইন্ডকে এড়িয়েই ‘স্যারের সাথে’ গল্প করছিলাম।

চারপাশে তাকিয়ে লক্ষ্য করলাম, ভীড় কমে গেছে। বিকেল গড়িয়ে গোধূলি এসে গেছে। একটু পরেই সন্ধ্যা, তারপর জোছনায় ভেসে যাবে চারদিক। হয়ত জোছনা দেখার জন্যই এখানে কোনো লাইটের ব্যবস্থা নেই। মঞ্চে কোনো টেবিল না থাকলেও এক সেট সোফা ছিল। হুমায়ূন আহমেদ সেই সোফায় বসেছেন। আমি সোফার পেছনে খড়ের গালিচায় ‘নো এন্ট্রি’ জোনে দাঁড়িয়ে তাঁর সাথে কথা বলছি। হুমায়ূন আহমেদ সোফায় বসে হেলান দেয়ার অংশে হাত রেখে কিছুটা ঘুরে তাকিয়ে আমার সাথে কথা বলছেন। তাঁকে হাসিখুশি দেখাচ্ছে, কিন্তু চিন্তিত মনে হচ্ছে। বয়সটাও একটু বেশি লাগছে। তিনি আমাকে নক্ষত্রের রাত সিনেমা সম্পর্কে বলতে শুরু করলেন। এরপর হিমুকে নিয়ে সিনেমা সম্পর্কেও বলবেন। স্যার আবার গল্প শুরু করতেই ঘুম ভেঙে গেল। অসাধারণ কিছু মুহূর্তের স্মৃতি নিয়ে ফিরে এলাম বাস্তব জগতে।

স্বপ্নের মধ্যে কেউ কেউ রং দেখতে পায়, কেউবা পায়না। আমি দেখতে পাই। খড়ের গালিচার সোনালী হলুদাভ রং আমার স্পষ্ট মনে আছে।

আজ ফজরের নামাজের পর দ্বিতীয় দফা ঘুমিয়ে এই স্বপ্নটা দেখলাম। লোকমুখে শুনেছি ভোরের দিকের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়। দিনের বেলায় যে স্বপ্ন দেখা হয় বইপত্রে সেগুলো ‘ডে ড্রিম’ বলে, যার মধ্যে সাধারণত বাস্তব পৃথিবীর সাথে আমাদের চিন্তাধারার সম্পর্ক সাময়িকভাবে ম্লান হয়ে যায়, ফলে নিজেদের ভালো লাগে এমন কিছু ব্যাপার স্বপ্নরূপে চলে আসে, হোক সেগুলো সম্ভব কিংবা অসম্ভব। সে যাই হোক, মাঝে মাঝে চমৎকার কিছু ঘটনার সাথে এভাবে ভার্চুয়ালি সংশ্লিষ্ট হওয়া মানেই এমন কিছু অভিজ্ঞতা পাওয়া যা সবার পক্ষে অর্জন করা সম্ভব নয়!

যে যেখানেই থাকুন, সবাই আনন্দেই থাকুন, সেই প্রত্যাশা রইল।

আরাফাত বিন সুলতান
সকাল ৭:৩০
১৪ অক্টোবর ২০১৬

📌 পোস্টটি শেয়ার করুন! 🔥

সর্বশেষ প্রযুক্তি বিষয়ক তথ্য সরাসরি আপনার ইমেইলে পেতে ফ্রি সাবস্ক্রাইব করুন!

Join 8,543 other subscribers

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *