স্টারলিংকের সাথে চুক্তি করলো রবি, পাওয়া যাবে যেসব সেবা

বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ খাতে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হলো রবির হাত ধরে। সম্প্রতি মোবাইল অপারেটর রবি ঘোষণা করেছে, তারা বিশ্বের শীর্ষ স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান স্টারলিংকের সাথে আনুষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এই চুক্তির মাধ্যমে রবি বাংলাদেশের প্রথম টেলিকম অপারেটর হিসেবে স্টারলিংকের অনুমোদিত এন্টারপ্রাইজ রিসেলার হয়ে উঠলো। অর্থাৎ, এখন থেকে রবি তাদের গ্রাহকদের কাছে সরাসরি স্টারলিংকের পণ্য ও সেবা পৌঁছে দিতে পারবে। সম্প্রতি বাংলাদেশে প্রথমবারের মত বাণিজ্যিকভাবে ৫জি চালু করেছে রবি, যা একটি মাইলফলক। এরপর নতুন এই চুক্তি নিঃসন্দেহে তাদেরকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসছে।

স্টারলিংক কী এবং কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ

স্টারলিংক হলো এলন মাস্কের প্রতিষ্ঠিত স্পেসএক্স-এর একটি স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা। পৃথিবীর কক্ষপথে হাজারো ছোট স্যাটেলাইট ব্যবহার করে এটি বিশ্বের দূরবর্তী অঞ্চলে উচ্চগতির ইন্টারনেট সরবরাহ করছে। যেখানে প্রচলিত মোবাইল নেটওয়ার্ক বা ব্রডব্যান্ড পৌঁছাতে পারে না, সেখানে স্টারলিংক হচ্ছে কার্যকর সমাধান।

বাংলাদেশের ভৌগোলিক বাস্তবতায় গ্রামীণ ও দুর্গম এলাকায় এখনো অনেক জায়গায় স্থিতিশীল ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়া যায় না। সেখানে স্টারলিংকের প্রযুক্তি বিশেষভাবে কার্যকর হতে পারে। আর রবির সাথে এই অংশীদারিত্ব দেশের কোটি মানুষের জন্য ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার পথে এক বিশাল অগ্রগতি।

রবির মাধ্যমে স্টারলিংকের কোন কোন সেবা পাওয়া যাবে?

এই চুক্তির মাধ্যমে রবি শুধু ঢাকার মতো বড় শহরেই নয়, বরং বাংলাদেশব্যাপী স্টারলিংকের পণ্য ও সেবা বিক্রি করতে পারবে। অর্থাৎ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল, যেখানে প্রচলিত ব্রডব্যান্ড লাইন বা মোবাইল নেটওয়ার্ক পৌঁছানো কষ্টসাধ্য, সেখানেও রবি স্টারলিংকের স্যাটেলাইট ইন্টারনেট পৌঁছে দিতে পারবে।

উদাহরণস্বরূপ, কক্সবাজারের সেন্টমার্টিন দ্বীপ বা হাতিয়ার মতো দ্বীপাঞ্চলে এখনো নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট পাওয়া কঠিন। আবার খাগড়াছড়ি বা বান্দরবানের পাহাড়ি এলাকাগুলোতেও নেটওয়ার্ক স্থিতিশীল থাকে না। এইসব জায়গায় স্টারলিংকের টার্মিনাল বসিয়ে সরাসরি স্যাটেলাইটের সাথে সংযুক্ত হয়ে সহজেই হাই-স্পিড ইন্টারনেট ব্যবহার করা যাবে।

starlink robi

🔥🔥 গুগল নিউজে বাংলাটেক সাইট ফলো করতে এখানে ক্লিক করুন তারপর ফলো করুন 🔥🔥

শুধু তাই নয়, চরাঞ্চল বা নদীভাঙন প্রবণ গ্রামগুলোতেও যেখানে নিয়মিত অবকাঠামো বসানো সম্ভব হয় না, সেখানে স্টারলিংকের সংযোগ হতে পারে কার্যকর সমাধান। এমনকি জরুরি পরিস্থিতি—যেমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা ঘূর্ণিঝড়ের সময় যখন প্রচলিত নেটওয়ার্ক ভেঙে পড়ে, তখনও স্টারলিংকের সেবা যোগাযোগ চালু রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। স্টারলিংকের ইন্টারনেট কিট (এন্টেনা, রাউটার প্রভৃতি) রবির কাছ থেকেই কিনতে পারবেন গ্রাহকরা।

চুক্তির আওতায় রবি দুই ধরনের সেবা গ্রাহকদের দিতে পারবেঃ লোকাল প্রায়োরিটি এবং গ্লোবাল প্রায়োরিটি

  • লোকাল প্রায়োরিটি সেবা: বাংলাদেশে অবস্থানরত ব্যবহারকারীদের জন্য নির্দিষ্ট গতি ও ব্যান্ডউইথ নিশ্চিত করা হবে। এটি মূলত স্থায়ী ব্যবহারকারীদের জন্য, যারা অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা সরকারি সংস্থায় নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট চান।
  • গ্লোবাল প্রায়োরিটি সেবা: এই প্যাকেজে পাওয়া যাবে আন্তর্জাতিক স্তরের প্রিমিয়াম কানেক্টিভিটি। মোবাইল ও পোর্টেবল ব্যবহারের জন্য এটি আদর্শ, বিশেষ করে যারা এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ভ্রমণ করেন বা চলমান কাজেও দ্রুত ইন্টারনেট চান।

এই সেবাগুলো ভিডিও কনফারেন্সিং, ই-লার্নিং, ক্লাউড কম্পিউটিং কিংবা ডিজিটাল কমার্সের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহার করা যাবে। ফলে শহরের মতোই গ্রামের শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী বা স্বাস্থ্যকর্মীরা নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট সুবিধা উপভোগ করতে পারবেন।

👉 স্টারলিংক ইন্টারনেট প্যাকেজের দাম ২০২৫ (বাংলাদেশ)

গ্রামীণ এলাকায় নতুন সম্ভাবনা

রবি শুধু এন্টারপ্রাইজ সেলস চ্যানেল বা অনুমোদিত রিটেইল আউটলেটের মাধ্যমেই স্টারলিংকের সেবা দেবে না, বরং কমিউনিটি-শেয়ারিং ওয়াই-ফাই সল্যুশনও চালু করার পরিকল্পনা করেছে। এর মানে হচ্ছে, গ্রামের মানুষ একসাথে সাশ্রয়ী খরচে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবে।

বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতি, শিক্ষা ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে এ ধরনের উদ্যোগ বড় ভূমিকা রাখবে। কারণ, এখনো অনেকে শুধু ইন্টারনেট সংযোগের অভাবে ডিজিটাল সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

রবির দৃষ্টিভঙ্গি

রবি অ্যাক্সিয়াটা পিএলসি-এর চিফ কমার্শিয়াল অফিসার, শিহাব আহমেদ বলেছেন, “বাংলাদেশের ডিজিটাল বিভাজন দূরীকরণের ক্ষেত্রে এটি একটি রূপান্তরমূলক পদক্ষেপ। প্রান্তিক অঞ্চলে উচ্চগতির স্যাটেলাইট ইন্টারনেট আনার মাধ্যমে স্থানীয় জনগণকে অপরিহার্য ডিজিটাল সেবা গ্রহণের সুযোগ দিচ্ছে রবি; যা অন্তর্ভুক্তি, উদ্ভাবন ও টেকসই অগ্রগতিকে বেগবান করবে।”

তার এই বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট, রবি শুধু ব্যবসায়িক দিক নয়, বরং সামাজিক দিক থেকেও এই চুক্তিকে গুরুত্ব দিচ্ছে।

কারা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে?

স্টারলিংকের সেবা কেবল সাধারণ গ্রাহকের জন্যই নয়, বরং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার জন্যও সমান কার্যকর।

  • শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো দূরবর্তী এলাকা থেকেও অনলাইন ক্লাস ও গবেষণা কার্যক্রম চালাতে পারবে।
  • স্বাস্থ্য খাতের জন্য টেলিমেডিসিন বা দূরবর্তী চিকিৎসা সেবা সহজ হবে।
  • সরকারি প্রতিষ্ঠান ও অফিসগুলো নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ বজায় রাখতে পারবে।
  • ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্লাউড কম্পিউটিং ও ডিজিটাল কমার্স আরও সহজলভ্য হবে।

সবচেয়ে বড় সুবিধা পাবে গ্রামীণ মানুষ, যারা এতদিন দ্রুতগতির স্থায়ী ইন্টারনেট সংযোগের বাইরে ছিল।

বাংলাদেশের ডিজিটাল ভবিষ্যৎ

বাংলাদেশ সরকার “ডিজিটাল বাংলাদেশ” এবং “স্মার্ট বাংলাদেশ” গড়ার যে লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে, সেটি বাস্তবায়নে নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট অপরিহার্য। তবে শুধু শহরমুখী অবকাঠামো গড়ে তুললেই হবে না, গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলকেও এই ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

রবি ও স্টারলিংকের এই অংশীদারিত্ব সেই দিকেই এক বড় পদক্ষেপ। কারণ, স্যাটেলাইট ইন্টারনেট এমন সব জায়গায় সংযোগ পৌঁছে দিতে পারে, যেখানে তার টানা বা নেটওয়ার্ক টাওয়ার বসানো প্রায় অসম্ভব।

👉 স্টারলিংকের সবচেয়ে কম দামের প্যাকেজ সম্পর্কে আপনার যা জানা দরকার

শেষ কথা

স্টারলিংকের সাথে রবির এই চুক্তি বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ খাতে যুগান্তকারী এক সংযোজন। এর মাধ্যমে শুধু প্রযুক্তিগত উন্নয়নই নয়, বরং সামাজিক ও অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিও নিশ্চিত হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা ও প্রশাসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে।

ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নকে আরও শক্তিশালী করতে এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। আর সময়ই বলে দেবে, কত দ্রুত ও কার্যকরভাবে এই সেবা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়।

📌 পোস্টটি শেয়ার করুন! 🔥

সর্বশেষ প্রযুক্তি বিষয়ক তথ্য সরাসরি আপনার ইমেইলে পেতে ফ্রি সাবস্ক্রাইব করুন!

Join 8,427 other subscribers

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *