ডায়েরিঃ প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ, আপনি এমন কেনো?

বলতে দ্বিধা নেই, ছোটবেলা থেকেই টিভি দেখা, গান শোনা বা মোটা মোটা উপন্যাস পড়া- কোনোটির প্রতিই আমার খুব একটা টান ছিলনা। আমার আগ্রহ ছিল ইলেকট্রনিক্সে। স্কুলে থাকাকালীন বাড়িতে আমার ছোটখাটো একটা ল্যাবরেটরি ছিল। সাংস্কৃতিক বিনোদন মাধ্যমের চেয়ে যন্ত্রপাতি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করাই আমার নিকট উপভোগ্য ছিল। এতকিছুর মধ্যেও টিভিতে কালেভদ্রে যেটুকু সময় চোখ পড়ত সেই অল্প সময়েই একজনের কাজ দেখতে দেখতে মনে হল “এগুলো তো বেশ উপভোগ্য“! তিনি হলেন হুমায়ূন আহমেদ। অপেক্ষা, আজ রবিবার, তিথির নীল তোয়ালে, মিসির আলি এসব দিয়েই হুমায়ূন আহমদের জাদুকরী জগতে প্রবেশ।

সত্যিকথা বলতে, বড় বড় উপন্যাস কিংবা পৃষ্ঠা পৃষ্ঠা গল্প/সাহিত্য পড়ার ধৈর্যও আমার ছিলনা। পাঠ্যবইয়ে থাকা সাহিত্যের বাইরে বাংলা সাহিত্যের খুব বেশি পড়া হয়নি আমার। বাংলা সাহিত্যের যতটুকু পড়েছি বা জেনেছি, তার বেশিরভাগই, অন্তত ৭০% হুমায়ূন আহমেদের লেখা। আর বাকীটা সাধারণ জ্ঞান হিসেবে পড়া।

হুমায়ূন আহমেদের নাটক ও চলচ্চিত্র দেখে বেশিরভাগ সময় হেসেছি, আবার মাঝে মাঝে মনও খারাপ হয়েছে। বলাই বাহুল্য, তিনি অনেক শক্তিশালী নির্মাতা ছিলেন। কিন্তু তারপরেও, হুমায়ূন আহমেদকে চিনতে হলে তার লেখা পড়ার কোনো বিকল্প নেই বলে আমার মনে হয়।

বড় বড় গল্প/উপন্যাস পড়ার প্রতি আমার যে একটা অধৈর্য কাজ করত, সেটা হুমায়ূন আহমেদের লেখা পড়ার সময় একদমই উলটো হয়। স্যারের হিমু সিরিজ আমার সবচেয়ে ভাল লাগে, যতই পড়ি প্রতিবারই নতুন মনে হয়। তিনি সত্যিই গল্পের জাদুকর! রহস্য, রোমান্স বা জ্ঞানগর্ভ বিষয়বস্তুর চেয়ে হিমুর সহজ সরল ‘ডোন্ট কেয়ার’ টাইপের জীবন এক অসাধারণ আকর্ষক।

কিন্তু স্কুল-কলেজে কিংবা ভার্সিটির শুরুর দিকেও হুমায়ূন আহমেদের লেখার প্রতি আমার এতটা আকর্ষণ তৈরি হয়নি। স্যার যেদিন পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন, সবাই যখন জানল, পুরো ফেসবুক নিউজফিড যেন শোকে হাহাকারে ভেসে গেলো। আমারও খারাপ লেগেছিল, কারণ ওনার আর কোনো নতুন নাটক পাবোনা এই ভেবে।

কিন্তু তখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি, হুমায়ূন আহমেদের প্রভাব আরও সহস্রগুণ বেশি।

ফেসবুকে আমার পরিচিত দুই ছোটভাই আছে যারা একে অপরের ভাই। ওদের মধ্যে যে বড়, সেই ছেলেটা ২০১১/১২ থেকেই কম্পিউটার বিষয়ক বিভিন্ন কাজে মাঝেমধ্যে নক করত। সম্ভবত ফেসবুকে আমার টেক সম্পর্কিত পোস্টগুলোর জন্যই এরকম হয়েছিল। ওরা একজন আরেকজনের সম্বন্ধে অভিযোগ/অনুযোগ করত, যেনো আমি ওদের অভিভাবক টাইপের কিছু। ওদের মধ্যে যে বড়, সে প্রোফাইল ইমেজে হুমায়ূন আহমেদের ছবি দিয়ে রাখত মাঝে মাঝে। আমি এটা নিয়ে ওকে প্রশ্ন করেছি, সে বলত হুমায়ূন স্যার তার আইডল- এরকম।

আমি তখনও বুঝতে পারিনি হুমায়ূন আহমেদের প্রভাব এত শক্তিশালী, এত জাদুকরী। স্যার যেদিন মারা গেলেন সেদিন বা তার পরের দিন রাতে হঠাত কম্পিউটার ওপেন করে দেখি ফেসবুকে সেই দুই ভাইয়ের একজন খুব বিদ্ধস্ত ও হতাশাগ্রস্ত স্ট্যাটাস দিয়েছে। আমি ওকে ফেসবুকে মেসেজ দিলাম যে কী ব্যাপার। সে বলল “ভাইয়া আমি এখন কী নিয়ে বাঁচব, হুমায়ূন স্যার তো আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন।” আমার আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা অস্বাভাবিকরকম বেশি। ওই মুহুর্তে আমি বুঝতে পারছিলাম সে মানসিকভাবে প্রচণ্ড ভেঙে পড়েছে। আমি ওকে প্রায় একঘণ্টা বোঝানোর চেষ্টা করলাম এভাবে ভেঙে পড়া ভাল না, তাছাড়া মানুষের বাবা-মা’ও তো চিরদিন বেঁচে থাকেনা, সবাই চলে যায়। আল্লাহ্‌র কাছে দোয়া করো যাতে তোমার প্রিয় লেখক ক্ষমা পান ও জান্নাতবাসী হন। শেষ পর্যন্ত ও কিছুটা স্বাভাবিক হল।

কিন্তু একটা মানুষের লেখায় এমন কী আছে যা পাঠকদের মাঝে এভাবে প্রভাববিস্তারকারী হয়? আমার কৌতূহল হল। এই ব্যাপারটা নিয়ে আমি আরও বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বললাম। তখনও আমি স্যারের লেখার খুব বেশি পাঠক হতে পারিনি।

এরপর বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে হুমায়ূন আহমেদের কয়েকটি বই নিয়ে পড়া শুরু করলাম। আগেই বলেছি, আমার সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে আগ্রহ তুলনামূলক কম। কিন্তু তার পরেও হুমায়ূন স্যারের লেখা পড়ে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলাম। হিমু সিরিজের একাধিক লেখা একনাগাড়ে পড়ে শেষ করে ফেললাম। স্যারের তৈরি নাটক/চলচ্চিত্র দেখে যতটা ভাল লাগে, লেখাগুলো পড়ে তার চেয়েও বেশি ভাল লাগে। অদ্ভুত সুন্দর সব বাক্য, অসাধারণ সব শব্দচয়ন… সত্যিই এ এক চমৎকার অভিজ্ঞতা।

বই যে মানুষের বন্ধু হতে পারে, তা হুমায়ূন আহমেদের বই না পড়লে বোধহয় এখনোও বুঝতে পারতাম না। যেকোনো পরিস্থিতিতে মন ভালো করে দেয়ার জন্য স্যারের লেখা পড়া যেতে পারে। ইতিবাচক ফলাফল গ্যারান্টেড।

হুমায়ূন আহমেদকে মাঝে মাঝে হিমুর বাবার মত রহস্যময় ও খেয়ালী মনে হয়। হিমুর বাবা যেমন হিমুর মন থেকে পৃথিবীর সকল মায়া কাটানোর জন্য অদ্ভুত সব কাণ্ড করেছেন, হুমায়ূন স্যারও যেন সেই একইরকমভাবে বিভিন্ন চরিত্র ও ঘটনার অবতারণা করেছেন। লেখা থেকে বাস্তব জীবন, সবক্ষেত্রেই। তিনি তার লেখায় থাকা চরিত্রগুলো নিয়ে অদ্ভুতভাবে খেলা করেছেন। তিনি বিভিন্ন চরিত্রকে হেসে-খেলে নিষ্ঠুর পরিণতি দিয়েছেন। ঠিক যেভাবে হিমুর বাবা তার টিয়াপাখিটির সাথে আচরণ করেছিলেন। পাঠক এমনটা সহ্য করতে পারবেনা, সেটা তিনি জানতেন, তারপরও হিমুর বাবার মত আমাদেরকে স্যার সবকিছুও সহ্য করিয়েছেন।

নাহয় এত অল্প সময়ে কেউ এতগুলো প্রিয় মানুষ কাঁদিয়ে চলে যায়?

হিমু ও রূপার গল্প যে আরও অনেকখানি বাকী রয়ে গেল। প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ স্যার, আপনি ওদেরকে এভাবে রেখে গেলেন কেন? আপনাকে খুব মিস করি। আপনি কি হিমুর বাবার মত কঠিন? নাকি হিমুর মত উদাসীন? নাকি রূপা চরিত্রের মত মায়ার আধার? আপনি আসলে কেমন? আপনি এমন কেন? আল্লাহ্‌ আপনাকে মাফ করুন।

moyurakkhi rupa himu

 – ময়ূরাক্ষী, হুমায়ূন আহমেদ। 

📌 পোস্টটি শেয়ার করুন! 🔥

সর্বশেষ প্রযুক্তি বিষয়ক তথ্য সরাসরি আপনার ইমেইলে পেতে ফ্রি সাবস্ক্রাইব করুন!

Join 8,549 other subscribers

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *