হুয়াওয়ে স্মার্টফোনের ভবিষ্যৎ কী?

হুয়াওয়ে এন্ড্রয়েড

গুগল সহ মার্কিন বেশ কিছু কোম্পানি চীনা টেক জায়ান্ট হুয়াওয়ের সাথে সব ধরনের ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করা ঘোষণা দিয়েছে। এ খবর কারো অজানা নয়। মূলত তথ্য পাচারের সন্দেহ থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তথা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের জরুরী নির্দেশেই তারা এ কাজ করছে। এই হুয়াওয়ে ইস্যু নিয়ে প্রযুক্তি বিশ্ব গরম বেশ কিছুদিন ধরেই। হুয়াওয়ে কিংবা গুগলের মতো কোম্পানিগুলো অনেক বড় হওয়াতে এখন আর এটা শুধু প্রযুক্তি বিষয়ক ইস্যুই নয়, বরং এটি বড় একটি অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে।

হুয়াওয়ে ইস্যুটি এখনো অনেক মানুষের কাছে পরিষ্কার না হওয়াতে অনেকের মনে অনেক প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই আজকের এই পোস্ট।

গ্রাহকদের হাতে থাকা হুয়াওয়ে ফোনগুলোর কী হবে?

গুগল এবং হুয়াওয়ে উভয় কোম্পানি ব্যবহারকারীদের উদ্বেগের প্রেক্ষিতে এই প্রশ্নের উত্তর ইতোমধ্যে দিয়ে দিয়েছে। তারা আলাদা আলাদাভাবে এই প্রশ্নের উত্তর দিলেও উত্তরের মূলকথা এক। সেটি হলো, বর্তমানে গ্রাহকদের হাতে থাকা ফোনগুলো এবং দোকানে থাকা অবিক্রীত, এমনকি ফ্যাক্টরিতে মুক্তির অপেক্ষায় থাকা ফোনগুলোও বরাবরের মতোই স্বাভাবিক সব এন্ড্রয়েড সিকিউরিটি প্যাচ আপডেট এবং গুগল প্লে প্রটেক্ট এর মতো সেবাগুলো পাবে।

তার মানে বিদ্যমান ফোনগুলো এই নিষেধাজ্ঞাতে পড়ছে না। তবে কতদিন পর্যন্ত এই সেবা বলবত থাকবে সেটা এখনো ধোঁয়াশাই আছে।

সাধারণভাবে ফ্ল্যাগশিপ ফোনগুলো লম্বা সময় ধরে আপডেট পায়। তাই বর্তমান হুয়াওয়ে ফ্ল্যাগশিপগুলো নিয়ে আশা করি চিন্তার কিছু নেই। এছাড়া সাধারণ ফোনগুলোও স্বাভাবিকভাবে যেমন আপডেট পেতো তেমনই পাবে আশা করা যায়। এখন পর্যন্ত গুগলের নিষেধাজ্ঞার পরেও সব হুয়াওয়ে ফোনেই গুগলের স্বাভাবিক কার্যক্রম চলছে এবং রেগুলার আপডেট আসছে।

এন্ড্রয়েডের বিকল্প আনছে হুয়াওয়ে?

গুগলের নিষেধাজ্ঞার বেশ আগেই এ ধরনের ঘটনার জন্য হুয়াওয়ে প্রস্তুত ছিল। কোম্পানিটি আশঙ্কা করছিল এরকম কিছু হলেও হতে পারে। বিভিন্ন টেক মিডিয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী হুয়াওয়ে গত ছয় বছর ধরে তাদের নিজস্ব এন্ড্রয়েডের বিকল্প ওএস নিয়ে ইন্টারনালি কাজ করে আসছিলো।

হুয়াওয়ে অনেক আগেই বিকল্প অপারেটিং সিস্টেমের তৈরির ইঙ্গিত দিয়েছে। তবে এ ব্যাপারে তারা বিস্তারিত বলেনি। এন্ড্রয়েডের স্বত্ব গুগল সংরক্ষণ করলেও এর একটি অংশ ওপেন সোর্স। অর্থাৎ সেটাকে মডিফাই করে যে কেউ নতুন এন্ড্রয়েডভিত্তিক ওএস বানাতে পারবে গুগলের অনুমতি ছাড়াই।

তাই হুয়াওয়ে এখনো চাইলে এন্ড্রয়েড ওপেন সোর্স ভিত্তিক নতুন ওএস বানাতে কিংবা বর্তমানে তাদের ইএমইউআই থেকে গুগল সার্ভিস বাদ দিয়ে গুগলের কোন সহায়তা ছাড়াই ফোনে যুক্ত করতে পারবে। ধারণা করা হচ্ছে সবকিছু এভাবেই চলতে থাকলে তারা আগামী বছরের মাঝেই নতুন ওএস এর ফোন আনবে।

হুওয়ায়ের নতুন ওএস কি দাঁড়াতে পারবে?

হুয়াওয়ের ইঙ্গিত দেয়া নতুন ওএস কি এন্ড্রয়েড ওপেন সোর্স ভিত্তিক হবে, নাকি লিনাক্স কার্নেল ভিত্তিক সম্পুর্ন নতুন ওএস হবে নাকি উইন্ডোজ কিংবা আইওএস এর মতো সম্পূর্ন নতুন কার্নেল্ভিত্তিক ওএস হবে সেটা এখনো অনিশ্চিত।

বর্তমানে বাজারের সব অ্যাপই এন্ড্রয়েড কিংবা আইওএস এর জন্য। বাজারে আরো কিছু ওএস থাকলেও তাদের জন্য ডেভেলপাররা অ্যাপ বানাতে খুব বেশী আগ্রহী নন। কারণ এন্ড্রয়েড ও আইওএস এর বাজার দখলই সবচেয়ে বেশি। তাই হুয়াওয়ে নতুন কোন ওএস আনলে সেটা যে অ্যাপ স্বল্পতায় ভুগবেনা তা কে বলতে পারে?

তবে তারা যদি এন্ড্রয়েড ওপেন সোর্স বা এওএসপি ভিত্তিক কোন ওএস আনে তাহলে সেটাতে সাধারণ এন্ড্রয়েড অ্যাপ সাপোর্ট করবে বলে এদিক থেকে তারা সুবিধা পাবে।

বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, হুয়াওয়ের নতুন ওএস এ গুগলের সার্ভিস প্রি-ইনস্টল্ড না থাকলেও সেটি সব এন্ড্রয়েড অ্যাপ সাপোর্ট করবে। তার মানে ব্যাপারটা অনেকটা শাওমি কিংবা হুয়ওয়ে ফোনের চায়না রম এর মতো হবে।

গুগলের সার্ভিস না থাকলে সাধারণ গ্রাহকদের অসুবিধা হবে সেটা বলাই বাহুল্য। ফোনে গুগল প্লে ও গুগল সার্ভিস অ্যাপ ম্যানুয়ালি ইন্সটল করতে হবে, গুগলের সিকিউরিটি আপডেট পাবে না- এমন অসংখ্য সমস্যা।

অনেকে বলছেন গুগলের নিষেধাজ্ঞার ফলে ফোনে জিমেইল, ইউটিউব, ম্যাপস চলবে না। এ ধারনাটি ভুল কিনা সঠিক তা সময় এলেই বোঝা যাবে। বর্তমানে শাওমির চায়নিজ রমযুক্ত ফোনে প্লেস্টোর সহ গুগলের অ্যাপ যেমন জিমেইল, ইউটিউব, ক্রোম এসবই ইনস্টল করা যাচ্ছে। হুয়াওয়ের ভবিষ্যত এন্ড্রয়েড ভিত্তিক ফোনেও এভাবে ম্যানুয়ালি প্লে স্টোর ইনস্টল করা যাবে কিনা তা এখনও নিশ্চিত না।

তবে হুয়াওয়ে যদি বুটলোডার আনলক করার সুযোগ দেয় তাহলে ফোন রুট করে ইচ্ছা করলে গুগলের অজ্ঞাতে আনঅফিশিয়ালি গুগল এর সার্ভিস ফোনে ইন্সটল করা সম্ভব হতে পারে।

তাই হুয়াওয়ের নতুন ওএস যতই ভালো হোক না কেন সেটি গুগলের সার্ভিস ছাড়া এন্ড্রয়েড কিংবা আইওএস এর পাশে কতটা দাঁড়াতে পারবে সেটাই দেখার বিষয়।

এই নিষেধাজ্ঞা কি শিথিল হতে পারে?

ইতোমধ্যে জেনেছেন যে ট্রাম্প প্রশাসন সাময়িকভাবে সবকিছু বিবেচনা করে হুয়াওয়েকে ৩ মাসের একটি সীমিত লাইসেন্স দিয়েছে মার্কিন কোম্পানির সাথে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার। যদিও এটা পার্মানেন্ট কিছু না। মানে হুয়াওয়েকে শেষ পর্যন্ত হয়তো বিকল্প দেখতেই হবে। তবে এটা নিঃসন্দেহে কিছুটা আশা জাগাচ্ছে।

ট্রাম্প আরো বলেছেন সামনে বেইজিংয়ে চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য চুক্তিতে তিনি হুয়াওয়েকেও যুক্ত করতে পারেন। তিনি হয়তো জেডটিই কোম্পানির মতো কোন শর্তের বিনিময়ে হুয়াওয়েকে স্বাভাবিক কার্যক্রম চালানোর অনুমতি দিতেও পারেন। সেটা সময়ই বলবে।

তবে ট্রাম্পের এই নিষেধাজ্ঞায় হুয়াওয়ের যেমন ক্ষতি হচ্ছে তেমনি এর প্রভাবে মার্কিন কোম্পানিগুলোরও ক্ষতি হবে। সামনে আসতে যাওয়া ৫জি প্রযুক্তির গুরুত্বপূর্ণ প্যাটেন্ট এর একটা বড় অংশ হুয়াওয়ের মালিকানাধীন। তাছাড়া হুয়াওয়ের ব্যাপারে চীনও আমেরিকার সাথে কঠোর হতে পারে। তাই ধারণা করা যায় মার্কিন কোম্পানিগুলোর চাপে কিংবা নিজেদের স্বার্থের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় পর এ নিষেধাজ্ঞা শিথিল হলেও হতে পারে।

এ মুহুর্তে আপনার কি হুয়াওয়ে ফোন কেনা উচিত হবে?

এটা কঠিন প্রশ্ন, যার উত্তর আপনার ব্যক্তিগত ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। এ নিষেধাজ্ঞার পরেও হুয়াওয়ে বাংলাদেশে তাদের মার্কেটিং চালিয়ে যাচ্ছে এবং গ্রাহকদেরকে বিচলিত না হতে পরামর্শ দিচ্ছে। হুয়াওয়ে একটি বিশাল কোম্পানি। তাই বাজারে থাকা ফোনগুলো কিনলে তাদের কথানুযায়ী আপনি কোনকিছু মিস করবেন না। বরং রেগুলার সব আপডেট ও সার্ভিস পাবেন।

আর পরবর্তিতে যদি দুর্ভাগ্যক্রমে এসব ফোনে এন্ড্রয়েড ও গুগলের সেবা বন্ধও হয়ে যায়, হুয়াওয়ে হয়তো তাদের গ্রাহকদের অকুল পাথারে পড়তে দিবে না। তারা নিশ্চয়ই তাদের নতুন ইকোসিস্টেম যেন খুব সহজে বিদ্যমান ফোনগুলোতে চলতে পারে সে ব্যবস্থা করবে। অর্থাৎ তারা যেহেতু ঘোষণা দিয়েছে তাই তারা গ্রাহকদের সর্বোচ্চ সেবা দিয়ে যাবে সে বিশ্বাসটুকু রাখাই যায়।

সব কিছুর পরেও বাজারে থাকা বর্তমান হুয়াওয়ে ফোন কিনতে গেলে গ্রাহকরা যে দ্বিতীয়বার ভাববেন তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। যিনি জীবনে একবারও ফোনের সফটওয়্যার আপডেট দেয়া নিয়ে চিন্তা করেননি তিনিও হুয়াওয়ে ফোন কিনতে গেলে জিমেইল ও ইউটিউব চলবে কিনা সেই চিন্তাটা করবেন। সুতরাং এসব দিক দিয়ে চিন্তা করলে হুয়াওয়ের ফোন বিক্রি যে কমবে তা বলাই বাহুল্য।

তাহলে হুয়াওয়ের কী হবে?

বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন করে ফেলেছেন! আসলে এই প্রশ্নের উত্তর স্বয়ং হুয়াওয়ে সিইও কিংবা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও দিতে পারবেন না। তবে এ কথা তো সত্যি যে এন্ড্রয়েডের লাইসেন্স না পেলে হুয়াওয়ের ফোন ব্যবসা মারাত্নক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। শুধু এন্ড্রয়েডই নয়, হুয়াওয়ে ফোনের প্রসেসর ও অন্যান্য অংশের জন্যও মার্কিন ব্যানের শিকার হচ্ছে।

এখন হুয়াওয়ে কোনটা রেখে কোনটা সামাল দেবে সেটাও এক বিশাল প্রশ্ন। এমনকি মেমোরি কার্ড ব্যবহার ও ওয়াইফাই প্রযুক্তি নিয়েও নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হুয়াওয়ে।

“বিপ্লব অথবা মৃত্যু”

সুতরাং “যুদ্ধটা” শুধু এন্ড্রয়েড নিয়ে নয়, বরং মোবাইল ডিভাইসের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়ে। এখন সময়ই বলে দেবে এখান থেকে কীভাবে উদ্ধার পাবে হুয়াওয়ে। এটা অনেকটা সেই বিখ্যাত উক্তিটির মত- “বিপ্লব অথবা মৃত্যু”। হুয়াওয়ে যদি এই পরিস্থিতি থেকে বিপ্লব তুলে না আনতে পারে, সেটা যেভাবেই হোক, তাহলে বিকল্প অপশন হিসেবে তাদের ফোন ব্যবসার মন্দা অনিবার্য হয়ে যাবে। এটা কতটা গভীর হবে তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

বোনাস: এ পর্যন্ত যতবার নিষেধাজ্ঞায় পড়েছে হুয়াওয়ে

সর্বশেষ প্রযুক্তি বিষয়ক তথ্য সরাসরি আপনার ইমেইলে পেতে ফ্রি সাবস্ক্রাইব করুন!

Join 7,990 other subscribers

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.