মহাশূন্যে মানবসৃষ্ট বর্জ্য ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে। বিগত কয়েক বছরে আমরা মহাশূন্যে থাকা বিভিন্ন উপগ্রহ ও রকেটের ধ্বংসাবশেষ পৃথিবীতে পড়তে দেখেছি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে। মূলত মহাশুন্যে পাঠানো বিভিন্ন যানবাহন, যন্ত্র বা উপগ্রহগুলো নির্দিষ্ট একটি সময়ের পর ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে। ফলে এসব বর্জ্য নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে ঘুরতে ঘুরতে অভিকর্ষ টানের ফলে পৃথিবীতে পতিত হয় অনেক সময়।
এটি যদিও জনমানবহীন জায়গাতেই বেশি হয় তবুও এতে করে মানব জীবনের ক্ষতি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। সামনে এমনই এক মানব বর্জ্যে পরিনত হতে যাচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন বা আইএসএস। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে চালু থাকা এই স্পেস স্টেশনের মেয়াদ ফুরোবে ২০৩০ সালে।
১৯৯৮ সালে এই স্পেস স্টেশনকে মহাশূন্যে স্থাপন করা হয়। প্রথমে একে মাত্র ১৫ বছরের পরিকল্পনা নিয়ে স্থাপন করা হলেও বর্তমানে তা দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে চালু রয়েছে সফলভাবে। এই ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন ৫ টি দেশের (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইউরোপ, কানাডা, জাপান) স্পেস এজেন্সিকে একসঙ্গে মিলে মহাশূন্যে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছে। বর্তমানে একটি ফুটবল মাঠের থেকেও বড় এই স্পেস স্টেশন মহাশূন্যের বিভিন্ন মিশনে নভোচারীদের সহায়তা করছে নিয়মিত। পৃথিবী থেকে এটি খালি চোখেই দেখা সম্ভব এবং প্রতিদিন ১৬ বার পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে এই স্পেস স্টেশন। পৃথিবী থেকে ৪০০ কিলোমিটার উপরে অবস্থিত স্পেস স্টেশনটি মহাশূন্যে মানুষের তৈরি সবথেকে বৃহৎ স্থাপনা।
এই স্পেস স্টেশন জুড়েই বিভিন্ন উন্নত প্রযুক্তি স্থাপন করা হয়েছে। পৃথিবীর অনেক বিষয় নিয়েই নিয়মিত তথ্য সংগ্রহ ছাড়াও গবেষণা কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন। কিন্তু সম্প্রতি নাসা স্পেস স্টেশন ধীরগতিতে কাজ করার মতো বিভিন্ন সমস্যা লক্ষ্য করেছে। মূলত ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন নিয়মিত একপাশে সূর্যের বিকিরণে গরম ও অন্যপাশে ঠাণ্ডা হয়ে থাকার মতো সমস্যার সম্মুখিন হয়। ফলে এতে থাকা বিভিন্ন যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে যায় দ্রুতই। আর তাই ২০৩০ সালের বেশি এই স্পেস স্টেশনকে ব্যবহার করা সম্ভব হবে না।
মূলত ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনকে ভেঙ্গে নিরাপদে পৃথিবীতে নিয়ে আসার একটি পরিকল্পনা লম্বা সময় ধরে করা হচ্ছে। তবে সেই পরিকল্পনায় নাসা কিছু নতুনত্ব আনতে চাইছে। পুরো স্পেস ষ্টেশনকে টেনে পৃথিবীতে জনশূন্য জায়গায় ভূপাতিত করার মাধ্যমে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনকে নিরাপদে নামিয়ে আনতে চায় তারা। আর এজন্য নাসা একটি বিশেষ মহাশূন্য যান তৈরি করবার পরিকল্পনা করছে।
ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনটি পৃথিবীকে কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট অক্ষে ঘুরে তবেই মহাশুন্যে ভেসে থাকছে। এই কক্ষপথ হতে বিচ্যুত করতে তাই বাড়তি কিছুর দরকার হবে। আর সেই লক্ষ্যেই এই বিশেষ ‘স্পেস টাগ’ তৈরি করা হবে। এতে করে সহজেই ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনকে টেনে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ভেদ করে প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যাওয়া যাবে এবং সেখানেই এটিকে পুড়িয়ে ফেলা হবে। প্রশান্ত মহাসাগরের এই নির্জন জায়গার নাম ‘পয়েন্ট নিমো’। একে স্পেসক্রাফটের কবরস্থানও বলা হয়।
এর আগে রাশিয়ার সঙ্গে মিলে নাসা ভিন্নভাবে এই স্পেস স্টেশনকে ধ্বংস করবার পরিকল্পনা করেছিল। মূলত রাশিয়ার রসকসমসের সঙ্গে মিলে কিছু বিশেষ এয়ারক্রাফটের মাধ্যমে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনকে কক্ষচুত্য করার পরিকল্পনা করেছিল। এই পদ্ধতিতে এর আগেও রাশিয়া তাদের একটি স্পেস স্টেশন নিরাপদভাবে পৃথিবীতে নামিয়ে এনেছিল। তবে রাশিয়ার সঙ্গে সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটায় রাশিয়া এই পরিকল্পনায় থাকবে বলে আশাবাদী নয় নাসা। রাশিয়া নিজেদের জন্য আলাদা স্পেস স্টেশন তৈরি করার পরিকল্পনা করেছে। এজন্য নাসা নিজেই ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনকে ধ্বংস করবার জন্য নতুন করে পরিকল্পনা করতে বাধ্য হচ্ছে।
নাসার ২০২৪ সালের বাজেট প্রস্তাবনায় দেখা গেছে যে নাসা ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন ধ্বংসের জন্য রাশিয়ার উপর নির্ভর করতে চাচ্ছে না। ২০২৪ সালের জন্য মোট ২৭ বিলিয়ন ডলারের বাজেট চেয়েছে নাসা যেখানে ১৮০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ রয়েছে নাসার পরিকল্পিত এই ‘স্পেস টাগ’ -এর জন্য। এর মাধ্যমে নাসা ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনকে নিরাপদে নামিয়ে আনতে চায় রাশিয়ার সাহায্য ছাড়াই। পরবর্তীতে এই স্পেস টাগ অন্যান্য বিভিন্ন মিশনেও কাজে লাগাতে চায় নাসা। তবে এই ১৮০ মিলিয়ন শুধুমাত্র স্পেস টাগ তৈরি শুরু করতেই দরকার হবে। পুরো স্পেস ক্রাফট তৈরি শেষ করতে ১৮০ মিলিয়নেরও অনেক বেশি খরচ হবে বলে ধারণা করছে তারা। প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার এই বিশেষ যান তৈরিতে দরকার হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
🔥🔥 গুগল নিউজে বাংলাটেক সাইট ফলো করতে এখানে ক্লিক করুন তারপর ফলো করুন 🔥🔥
যদিও রাশিয়ার সাথে মিলে পূর্বের পরিকল্পনাটি এখনও পুরোপুরি বাতিল করে দেয়নি নাসা। রাশিয়ার একটি কার্গো শিপ ব্যবহার করে রোবটের মাধ্যমে ধীরে ধীরে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনকে কক্ষচ্যুত করার এই পরিকল্পনা নিয়ে নাসা এখনও আশাবাদী। কিন্তু নাসা এসব ব্যাপারে নিজেদের সক্ষমতা অর্জন করে রাশিয়ার উপর থেকে নির্ভরতা কমাতে চায়। অন্যান্য বিভিন্ন স্পেস এজেন্সিগুলো ইতোমধ্যেই কক্ষচ্যুত করার ক্ষমতা অর্জন করেছে। কাজেই নাসাও নিজেদের হাতে এই ক্ষমতা রাখতে চায়। আরও জানুন, মঙ্গলগ্রহে থাকা নাসার রোবট ‘ইনসাইট’ এর করুণ বিদায়!
গতবছর রাশিয়া ঘোষণা করে যে ২০২৪ সাল হতে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন আর ব্যবহার করবে না রসকসমস। এছাড়াও তারা নিজেদের স্পেস স্টেশন তৈরির পরিকল্পনার কথাও ঘোষণা দেয়। শুধু তাই নয় রাশিয়ার সয়ুজ নামক স্পেস মিশনের তথ্য নিয়মিত ফাঁস হয়ে যাওয়ায় তাদের উপর নির্ভরতার ব্যাপারটিও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। একারণেই নাসা নিজেদের হাতে বিকল্প রাখতে চায় মহাশূন্যের সকল মিশনের ক্ষেত্রেই।
নাসা বাজেটের আবেদন করলেও কোন পদ্ধতিতে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনকে পৃথিবীতে নামিয়ে আনা হবে তা বিজ্ঞান ছাড়াও নির্ভর করছে রাজনীতির উপরে। ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনের মতো এতো বড় একটি স্থাপনা এর আগে কখনই পৃথিবীতে নামিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়নি। নিয়ন্ত্রণবিহীনভাবে এই স্টেশন পৃথিবীতে ভূপাতিত হলে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে এই ব্যাপারে কোনরকম ঝুঁকি নিতে চায় না নাসা।
এর আগেও ১৯৭৯ সালে নাসার স্কাইল্যাব নামক একটি স্পেস স্টেশন নিয়ন্ত্রণবিহীনভাবে ভূপাতিত হয়েছিলো অস্ট্রেলিয়ায়। তবে এতে কারো কোন ক্ষতি না হলেও এরপর থেকেই নাসা এই ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে পদক্ষেপ নেয়। ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন বেশ বড় স্থাপনা হওয়ায় একে বিশেষভাবে ধ্বংস করার প্রয়োজন হবে। আর তাই এই ব্যাপারে পুরোপুরি প্রস্তুত থাকতে চায় নাসা। আরও জানতে পারেন, স্পেসএক্স সম্পর্কে যেসব তথ্য আপনার জানা উচিত।
- বাংলাটেক ফেসবুক গ্রুপে যোগ দিয়ে প্রযুক্তি বিষয়ক যেকোনো প্রশ্ন করুনঃ এখানে ক্লিক করুন।
- বাংলাটেক ফেসবুক পেইজ লাইক করে সাথে থাকুনঃ এই পেজ ভিজিট করুন।
- বাংলাটেক ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করতে এখানে ক্লিক করুন এবং দারুণ সব ভিডিও দেখুন।
- গুগল নিউজে বাংলাটেক সাইট ফলো করতে এখানে ক্লিক করুন তারপর ফলো করুন।
- বাংলাটেক সাইটে বিজ্ঞাপন দিতে চাইলে যোগাযোগ করুন এই লিংকে।
- প্রযুক্তির সব তথ্য জানতে ভিজিট করুন www.banglatech24.com সাইট।