ফ্রিল্যান্সারের ডায়েরিঃ হারিয়ে যাওয়া সেই বসন্ত ও আমার সাদাকালো দিনগুলি…

Arafat Capturing HD2243 bt24

শীতের পর বসন্ত আসে, এটা সেই প্রাইমারি স্কুলের আগে থেকেই জানা ছিল। কিন্তু শীত-বসন্তের সন্ধিলগ্নে প্রকৃতিতে যে অসাধারণ একটা পরিবর্তন আসে সেটা অনুভব করেছি ক্লাস এইট/নাইনে এসে। সে এক চমৎকার অভিজ্ঞতা যা ভাষায় প্রকাশ করা যায়না। শীতের বিদায় নেয়ার সময় হলে দক্ষিণা বাতাস বয়, সূর্যের তাপ তখনও সহনীয় থাকে এবং এই সময়টাতে খোলা মাঠে হেঁটে বেড়াতে অসম্ভব ভালো লাগে। ঠাণ্ডা না, আবার গরমও না- মোহনীয় দক্ষিণা বাতাস, সূর্যের মিষ্টি রোদ, সেই সাথে মেঠো পথের কোমল-পরিচ্ছন্ন ছোঁয়া এক অবাক করা ভালোলাগার অনুভূতি যোগায়।

এরকম সিজনে আমরা মেঠোপথ ধরে স্কুলে যেতাম। ক্লাস সেভেনে আমাদের নতুন টিচার এলেন। তাঁকে “বিএসসি” স্যার বলেই সবাই সম্বোধন করত। তিনি মূলত অংক ও বিজ্ঞান ক্লাস নিতেন। ইংরেজিও পড়াতেন। এক শীতের দুপুরে স্কুল থেকে ফেরার সময় স্যার বলছিলেন “দখিণা বাতাস বইছে, বসন্ত আসছে”। পিটুনি খাওয়ার ভয়ে স্যারের কথা খুব মনযোগ দিয়ে শুনতাম। সেইদিন বসন্তের সৌন্দর্যটা খেয়াল করলাম। অবাক লাগে, তখন কত ছোট ছিলাম, প্রকৃতির পরিবর্তনগুলো দেখলেও অনুভূত হতনা।

“বিএসসি স্যার” অত্যন্ত বন্ধুবৎসল হলেও তার রাগটা একটু বেশি ছিল। কোথায় যেন শুনেছিলাম “ভিটামিন বি এর অভাব থাকলে মেজাজ খিটখিটে হয়”- সত্যিমিথ্যা যাচাই না করেই স্যারের জন্য ভিটামিন বি সমৃদ্ধ খাবারের একটা লিস্ট তৈরি করে তাঁকে সাজেস্ট করেছিলাম। ক্লাসে কথা বললে বা এদিকওদিক তাকালে স্যারের বেতের বাড়ি খাওয়া অবধারিত ছিল। পড়ার জন্য কখনো পিটুনি না খেলেও ক্লাসে কথা বলা বা জানালার বাইরে তাকানোর জন্য বিএসসসি স্যারের অনেক পিটুনি হজম করেছি। ক্লাসের ফার্স্ট বয় ছিলাম তাই বলে কখনো ছাড় পাইনি! প্রতিবার একটি বেত। এখনো স্বাদটা মনে আছে।

একজন মানুষের জীবনে তার শিক্ষকদের ভূমিকা সবসময় স্মরণীয় থাকে। স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি ও তারপর প্রফেশনাল লাইফে অনেক বন্ধুবৎসল মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে। বিএসসি স্যার তাঁদের মধ্যে অন্যতম। স্যারের সাথে অনেক দুষ্টুমি করতাম- তাঁর মোবাইল নম্বরে অনবরত মিসডকল দিতাম। কলব্যাক এলে রিসিভ করে ফোন মিউট করে দিতাম। এমনকি ক্লাসে থাকাকালেও ফোন দিয়ে রিসিভ হওয়ার আগে কেটে দিতাম।

একসময় স্যার জেনে গেলেন এগুলো আমি করছি। ততদিনে আমি এসএসসি পরীক্ষার্থী। হয়ত সেজন্যই স্যার কোনো বকাঝকা করেননি। একটা সময় এলো, স্যারের ক্লাসে একটা কিছু বুঝেও না বোঝার ভান করে কথা বাড়িয়ে তার আন্তরিক পাঠদান দেখে মুগ্ধ হতাম। তিনিও বেশিরভাগ সময়েই সেটা ধরে ফেলতেন।

অল্পকিছুক্ষণ কিছু মানুষের কাছ থেকে যে স্নেহ-ভালোবাসা পেয়েছি, যেভাবে উচ্ছলতা-আনন্দে সময় কেটেছে তা কোনোদিন ভোলার নয়। আমরা অনেক কাছের মানুষদের কাছ থেকেই অনেক কিছু আশা করি, কিন্তু তার ধারেকাছেও কেয়ারিং জিনিসটা পাইনা। আবার অনেকের কাছ থেকে অনেক প্রত্যাশাতীত স্নেহ-ভালোবাসা পাই।

আমার বেশ গল্পসল্প করার ঝোঁক ছিল। কিন্তু স্কুল, কলেজে পড়ার সময় মাগরিব নামাজের পরই ঘরে ফিরে আসতাম, এরকমই আদেশ ছিল বাসা থেকে। ভার্সিটিতে বা প্রফেশনাল লাইফে এরকম বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু তার পরেও সেই দিনগুলো মিস করি। সেই হাসিভরা সরল দিনগুলো মিস করি। স্যারের বেতগুলোও কিছুটা মিস করি (বেতের বাড়ি না)। একবার বেত খাওয়ার পর নতুন কোনো উদ্ভট প্রশ্ন করে স্যারের কিছু কথা খরচ করতাম। সেই আন্তরিকতা মিস করি। আমি আমার সেই স্কুলজীবন মিস করি। মাগরিবের নামাজের পরপরই ঘরে ফিরে যেতে আমার কোনো আপত্তি নেই। যা ইচ্ছা করার অবাধ-স্বাধীনতা আমার দরকার নেই, আমি বাবা-মায়ের কাছে প্রতি মিনিটের হিসেব দিতে কোনো ক্লান্তি অনুভব করিনা, শুধু সেই সহজ, সুন্দর নির্ভার ও হাসিভরা দিনগুলো ফিরে পেতে চাই।

📌 পোস্টটি শেয়ার করুন! 🔥

সর্বশেষ প্রযুক্তি বিষয়ক তথ্য সরাসরি আপনার ইমেইলে পেতে ফ্রি সাবস্ক্রাইব করুন!

Join 8,545 other subscribers

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *