হলুদসন্ধ্যার গদ্য

পৃথিবী থেকে ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়েছিল প্রায় ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে। শৈশবেই পত্রিকা ও বই পড়ে এ সম্পর্কে ধারণা পেয়েছি। কিন্তু ‘হলুদসন্ধ্যা’ নামক অদ্ভুত এক অনুষ্ঠান যে এখনও বাংলাদেশে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তা জানতে কৈশোরের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। যদিও এর আদি সংস্করণ দিনের বেলায় হতে দেখেছি অনেক আগেই।

এসব ”সান্ধ্য” প্রোগ্রাম সাধারণত রাত ৮টার আগে শুরু হয়না। কাজেই এর নাম ‘হলুদরজনী’ হলেই বেশি মানাতো। আগে জানতাম এজাতীয় অনুষ্ঠান শুধুমাত্র পাত্র অথবা কেবল পাত্রীকে ঘিরে হয়। কিন্তু একাধিক ‘হলুদরজনী’তে পাত্রপাত্রী উভয়কেই সহাস্যমুখে মিষ্টিমুখ করতে দেখেছি। তাই এর স্বরূপ সম্পর্কে কিছুটা কনফিউজড হয়ে গিয়েছিলাম।

‘হলুদসন্ধ্যা’ জিনিসটা শুনতে সহজ লাগলেও আসলে ব্যাপারটা একটু জটিল। এতে অংশ নিতে চাইলে বিশেষ ড্রেসকোড মানতে হয়। এই যেমন ধরুন হলুদ শাড়ি ও ম্যাজেন্টা পাঞ্জাবি যার যেটা প্রযোজ্য।

তো, একবার একটা সান্ধ্যহলুদের অনুষ্ঠানে (পাত্রীপক্ষের) গেলাম। ড্রেসকোড না মেনে অফিসের রেগুলার হাফ-ফরমাল পোশাকেই গিয়ে উপস্থিত। নিজেকে ভিনগ্রহের প্রাণি মনে হচ্ছিল প্রথম কয়েক মিনিট। পাত্রপক্ষের সদস্য হওয়ার কারণে ১৫ কেজি ওজনের ফলের তোড়া (মূলত ঝুড়ি, কিন্তু সাজানোর কারণে তোড়ার মত লাগছিল) একহাতে করে এগিয়ে যাচ্ছি মঞ্চের দিকে। মিষ্টির বক্সের ওজন কম বলে সেগুলো বহন (কিংবা ডিসপ্লে) করার সৌভাগ্য হয়েছে আপুমণিদের।

যাইহোক, দুই পাশে ফুলের পাপড়ি ও লাইভ মিষ্টিমুখের আয়োজন নিয়ে অপেক্ষমাণ ইউনিফর্ম পরা তরুণী ও তরুণের দল। আমি ইউনিফর্মে অভ্যস্ত না। স্কুলের ১০ বছর একদিনও ইউনিফর্ম পরতে হয়নি, কারণ আমার স্কুলে তখনও এর প্রচলনই হয়নি। লাল-হলুদের ভীরে নিজেকে ইউনিক লাগছে। ওদিকে ফলের ভারে একহাতে ঝিঁঝিঁ ধরে যাচ্ছে। বাধ্য হয়েই সিরিয়াল ব্রেক করে সবার আগে সামনে গিয়ে যথাস্থানে ফল অর্পণ করলাম।

১০ মিনিট অতিক্রম হয়েছে। হাত এখনও পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। মস্তিষ্ককে অন্যকোনো দিকে ব্যস্ত করে দিলে কিছুটা স্বস্তি মিলতে পারে। এই ভেবে একজনকে জিজ্ঞেস করলাম “পাত্র কোথায়?”।

ভদ্রলোক বললেন “এখানে তো পাত্র থাকবেনা। এটা পাত্রীর জন্য প্রোগ্রাম “।

“আমি যে শুনলাম পাত্রের আসার কথা ছিল…”

“ওটা তো সারপ্রাইজ! পাত্র তার বন্ধুবান্ধব নিয়ে আসবে গভীর রাতে। সবাই চমকে যাবে। একটু দেখাসাক্ষাৎ করে আবার বিদায়। এটা হচ্ছে ওপেন সিক্রেট”।

এতবড় একটা ওপেন সিক্রেট শুরুতে ধরতে না পারায় কিছুটা বিব্রত বোধ করলাম। ওদিকে রাত ১০টা বেজে যাচ্ছে। আমাকে বাসায় ফিরতে হবে। ইচ্ছে করলেও সাড়ে ১১টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে সারপ্রাইজ দেখতে পারছিনা। এটা ভেবে দ্বিতীয় দফা বিব্রত হতে যাব এমন সময় খাওয়াদাওয়া শুরু হল।

সন্ধ্যায় অফিসের পার্টি থাকায় ডিনার অলরেডি কমপ্লিট। এখানে নিয়মরক্ষার জন্য এক প্লেটেই সামান্য বিরিয়ানি ও অন্যান্য আইটেম (ডেজার্ট সহ) একবারে নিয়ে টেবিলে চলে এলাম। আমার দেখাদেখি আমার সাথে থাকা আরো দুইজন একই কাজ করল।

আমাদের টেবিলে এক ভদ্রলোক এসে এই কাণ্ড দেখে যথাসম্ভব অবাক হলেন। তিনি বললেন “তোমরা চামচ থাকতে হাত দিয়ে কেন?”

আমি বললাম “আংকেল আমরা এভাবেই খাই”।

“পুডিংও নিয়েছো?”

“জি, আপনি পুডিং পাননি? টেবিলের একদম শেষ কোণায় পুডিং আছে। একটা না, দুটো আনবেন। পুডিংটা ভালই হয়েছে”।

“না, আমি বলছিলাম পুডিং তো ভিন্ন প্লেটে আনতে হত। ডেজার্ট সবার শেষে খেতে হয়না?”

“এভাবে খেতেও মন্দ লাগছেনা। আপনিও ট্রাই করেন, ভাল লাগবে। আপনিতো কোল্ড ড্রিংক আনেননি। দায়িত্বরত কারো কাছে চাইলেই দেবে।”

আংকেল কোল্ড ড্রিংক নিলেন। তিনি সেভেন আপ চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই মুহূর্তে সেখানে শুধু মিরিন্ডা অবশিষ্ট ছিল। তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হল।

ছুড়ি-চামচ দিয়ে খাওয়ার অভ্যাস যে আমার গড়ে ওঠেনি তা না। এখানে ইচ্ছেকরেই অত হাংগামায় যাইনি। সাথে দুইজন লোক থাকায় নিজস্ব একটা আবহ তৈরি করার জন্যই হস্ত প্রক্রিয়া অবলম্বন করেছি। হাত দিয়ে ভাত জাতীয় খাবার খাওয়ার যে ইউএক্স, সেটা চামচে আনা সম্ভব না। তাহলে খাওয়ার আগে ও পরে লাইফবয় হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে দুইহাত ধোয়ার বিজ্ঞাপন তৈরি হতনা। বিজ্ঞাপন হত ছুড়ি-চামচ ধোয়ার। সাকিব আল হাসান হাসিমুখে বলতেন ‘খাওয়ার আগে আপনার কাঁটাচামচ ও চাকুটি দশ সেকেন্ড ধরে লাইফবয় হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে ধুয়ে নিন’।

আমাদের সামনের ভদ্রলোক একটামাত্র টেবিলচামচ নিয়ে হাড় থেকে মাংস ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছেন। রবার্ট ব্রুসের মতই ধৈর্যশীল তিনি। পরিস্থিতি দেখে আমি তাকে হাত লাগানোর কথা বললাম। তিনি এটাকে ঠিক সম্মানজনক কোনো সমাধান বলে মনে করলেন না। এরপর বাড়তি একটা কাঁটাচামচ বা ছুড়ি টাইপের কিছুর সাহায্য নিতে পরামর্শ দিলাম। এবার তিনি আর না করলেন না।

খাওয়াদাওয়া পর্ব শেষ হল। মঞ্চে নাচগান চলছে। পাত্রের আসতে এখনো ঘন্টাখানেক লাগতে পারে। রাত ১১টার কাছাকাছি বেজে গেছে। আমার এখন প্রস্থান করাই শ্রেয়। মোবাইলের চার্জ ২৫ শতাংশে নেমে এসেছে। এখানে মোবাইল চার্জ দেয়ার পাবলিক বুথ দেখছিনা। কিংবা থাকলেও তাতে আমার মোবাইলের ইউএসবি-সি টাইপের চার্জার থাকার সম্ভাবনা খুবই কম হওয়ার কথা, কারণ এই পোর্টটি এখনও আমাদের দেশে অতটা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছেনা।

পরের দিন অফিস আছে। এশার নামাজ এখনও আদায় করা হয়নি। কাজেই এবার ফিরতে হবে। মুরুব্বীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে একটা উবার ডেকে চলে এলাম নিজের স্থানে। রাত পৌনে ১২টা নাগাদ শেষ হল বছরের প্রথম হলুদ অভিযান।

📌 পোস্টটি শেয়ার করুন! 🔥

সর্বশেষ প্রযুক্তি বিষয়ক তথ্য সরাসরি আপনার ইমেইলে পেতে ফ্রি সাবস্ক্রাইব করুন!

Join 8,545 other subscribers

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *