এই রোবটিক চোখ মানুষের চোখের চেয়েও শক্তিশালী!

মানুষের চোখ অত্যন্ত সূক্ষ্ম, অত্যন্ত জটিল। কিন্তু বিজ্ঞান থেমে থাকে না। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে এমন এক গবেষণা, যেখানে বিজ্ঞানীরা এমন একটি রোবটিক চোখ তৈরি করেছেন যা মানুষের চোখের তুলনায় আরও ভালোভাবে, আরও স্পষ্টভাবে এবং আরও দ্রুত জিনিস দেখতে পারে। প্রযুক্তির এই নতুন উদ্ভাবন নিয়ে মানুষের আগ্রহ ও আলোড়ন দুটোই স্বাভাবিক। কারণ এটি শুধু সাধারণ রোবটিক্স নয়, এটি ভবিষ্যতের চিকিৎসা, উদ্ধার কার্যক্রম, মাইক্রোস্কোপি গবেষণা, এমনকি স্মার্ট ডিভাইসের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির গবেষকরা “ফটো-রেস্পনসিভ হাইড্রোজেল সফট লেন্স (PHySL)” নামে এক ধরনের নরম রোবটিক লেন্স তৈরি করেছেন। এই লেন্সের কাজ, বৈশিষ্ট্য ও সম্ভাবনা এতটাই উন্নত যে এটি মানুষের চোখের ক্ষমতাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে।

এই রোবটিক চোখ আসলে কী?

গবেষকরা যে লেন্সটি তৈরি করেছেন, সেটি মূলত এক ধরনের হাইড্রোজেল-ভিত্তিক রোবটিক চোখ। হাইড্রোজেল এমন একটি নরম পদার্থ যা আর্দ্রতা ধরে রাখতে পারে এবং পরিবেশ অনুযায়ী সংকোচন বা প্রসারণ করতে সক্ষম। গবেষকরা এই হাইড্রোজেলের সাথে যুক্ত করেছেন সিলিকন পলিমার লেন্স এবং অতি ক্ষুদ্র গ্রাফিন অক্সাইড স্তর। গ্রাফিন অক্সাইড আলো শোষণ করতে পারে এবং আলো পড়লেই হাইড্রোজেলের ভেতরে ক্ষুদ্র পরিবর্তন তৈরি হয়। সেই পরিবর্তন লেন্সকে সঙ্কুচিত বা স্ফীত করে, যার ফলে লেন্সের ফোকাস পরিবর্তিত হয়।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এটি কাজ করতে কোনো বৈদ্যুতিক মোটর বা ব্যাটারির প্রয়োজন হয় না। কেবল আলোই এর ফোকাস পরিবর্তনের জন্য যথেষ্ট। মানুষের চোখের পেশিগুলো যেভাবে প্রাকৃতিকভাবে ফোকাস পরিবর্তন করে, এই রোবটিক চোখও ঠিক সেই ক্ষমতাই অনুকরণ করছে, তবে আরও উচ্চমাত্রার নির্ভুলতায়।

মানুষের চোখের চেয়েও ভালো দৃষ্টি? কীভাবে সম্ভব?

মানুষের চোখ নিখুঁত হলেও তার কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন খুব ক্ষুদ্র বস্তুর উপর ফোকাস করা, আলো দ্রুত পরিবর্তিত হলে দ্রুত মানিয়ে নেওয়া, অথবা নির্দিষ্ট দূরত্বে অতিরিক্ত স্পষ্টতা পাওয়া। এসব বিষয়ে মানুষের চোখের একটা প্রাকৃতিক সীমা রয়েছে।

soft robotic eye

🔥🔥 গুগল নিউজে বাংলাটেক সাইট ফলো করতে এখানে ক্লিক করুন তারপর ফলো করুন 🔥🔥

কিন্তু এই রোবটিক চোখ এসব জায়গায় মানুষকে পিছনে ফেলে দিয়েছে। গবেষকরা বলেছেন, এটি মাত্র ৪ মাইক্রোমিটার আকারের বস্তুকেও স্পষ্টভাবে দেখতে পারে। মানুষের চোখে এত ছোট বস্তু সরাসরি দেখা অসম্ভব। বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, একটি পিঁপড়ার পায়ের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র লোম পর্যন্ত এই লেন্স শনাক্ত করতে পারে। এই পর্যায়ের সূক্ষ্মতা সাধারণ অপটিক্যাল লেন্স বা মানুষের প্রাকৃতিক দৃষ্টিশক্তি কোথাও পৌঁছায় না।

এছাড়া লেন্সটি আলো অনুযায়ী মুহূর্তেই তার ফোকাস বদলে ফেলতে পারে। মানুষের চোখের ফোকাস যেভাবে পেশির সাহায্যে কিছুটা সময় নিয়ে পরিবর্তিত হয়, রোবটিক চোখ সেটি আরও দ্রুত করতে সক্ষম।

এই প্রযুক্তির সম্ভাব্য ব্যবহার কোথায়?

বিশ্বজুড়ে সফট রোবট (soft robotics) বিষয়ক গবেষণা দ্রুতগতিতে বাড়ছে। সেখানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কীভাবে রোবটকে এমন দৃষ্টি দেওয়া যায়, যা মানুষের মতো বা তার থেকেও উন্নতভাবে পরিবেশ সনাক্ত করতে পারে। এই রোবটিক চোখ সেই কাঙ্ক্ষিত সমাধান এনে দিতে পারে।

চিকিৎসা ও সার্জারি

বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে সার্জারি-রোবট বা মেডিক্যাল রোবোটিক্স নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। ভবিষ্যতে যদি এমন লেন্স ব্যবহৃত হয়, তাহলে ডাক্তাররা অত্যন্ত সূক্ষ্ম স্থানে ও অপারেশনে আরও সুবিধাজনকভাবে কাজ করতে পারবেন। বিশেষ করে মাইক্রো-সার্জারি, ন্যানো-সার্জারি বা চোখের ভেতরের অংশ নিয়ে কাজ – এসব ক্ষেত্রে দারুণ অগ্রগতি দেখা যেতে পারে।

👉 এক চার্জে ৫৭০০ বছর চলবে এই ব্যাটারি

অনুসন্ধান ও উদ্ধার

ধ্বংসস্তূপ, খনি, ভূগর্ভস্থ গুহা বা এমন সব জায়গা যেখানে আলো কম এবং প্রবেশ করা কঠিন, রোবট যদি নিজে থেকেই অত্যন্ত স্পষ্ট দৃষ্টি পায়, তাহলে উদ্ধার কাজ অনেক সহজ ও নির্ভুল হবে। ভূমিকম্প বা ভবন ধসে পড়ার ঘটনায় এমন রোবট বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

মাইক্রোস্কোপি ও গবেষণা

মাইক্রোস্কোপ সবসময় শক্তির উপর চলে, এবং ফোকাস ঠিক করতে জটিল ব্যবস্থা ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু এই রোবটিক চোখ ব্যবহারে এমন একটি মাইক্রোস্কোপ তৈরি করা সম্ভব, যা নিজে থেকেই আলো অনুযায়ী ফোকাস পরিবর্তন করতে পারে। এতে গবেষণা আরও দ্রুত হবে, নির্ভুলতাও বাড়বে।

ভবিষ্যতের স্মার্ট ডিভাইস

ধরা যাক আপনার ফোনের ক্যামেরায় ভবিষ্যতে এমন লেন্স ব্যবহার হলো। তাহলে ফোন আলো অনুযায়ী নিজে থেকেই মুহূর্তে ফোকাস ঠিক করবে, মাইক্রো-ডিটেইল আরও ভালোভাবে ধরবে, এমনকি ব্যাটারি খরচও কম হবে। স্মার্ট গ্লাস, VR হেডসেট বা রোবট ভ্যাকুয়াম, সব জায়গায় এই প্রযুক্তির প্রভাব পড়তে পারে।

👉 স্পেস স্যুট সম্পর্কে চমকপ্রদ কিছু তথ্য যা আপনার জানা ছিল না

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই প্রযুক্তির গুরুত্ব

বাংলাদেশে রোবটিক্স নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। যদিও শিল্প-পর্যায়ে বাস্তবায়ন এখনো খুব সূচনাতেই, তবে প্রযুক্তির দিক থেকে আমরা পিছিয়ে নেই। তাই ভবিষ্যতে যদি এই প্রযুক্তি সুলভ হয়, তাহলেঃ

  • বাংলাদেশের চিকিৎসা খাতে উন্নত সার্জারি-রোবট ব্যবহার হতে পারে।
  • উদ্ধার অভিযানে সফট রোবট ব্যবহার করে ধ্বংসস্তূপে আটকে থাকা মানুষকে দ্রুত খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে।
  • গবেষণাগারে উন্নত মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা আরও নতুন কিছু আবিষ্কার করতে পারবেন।
  • সব মিলিয়ে এটি দেশের প্রযুক্তি-খাতে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে।

নৈতিকতা ও নিরাপত্তা, যা মাথায় রাখতে হবে

যেকোনো উন্নত সেন্সর বা রোবটিক চোখ প্রযুক্তির মতো এখানেও কিছু ঝুঁকি আছে। বিশেষ করে গোপনীয়তা, নজরদারি, ডেটা সংগ্রহ – এসব বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। কারণ যেকোনো ক্যামেরা-ভিত্তিক সিস্টেম অপব্যবহার হলে তা সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই গবেষণা ও ব্যবহারের পাশাপাশি নৈতিক নির্দেশিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

👉 উড়োজাহাজ নিয়ে ১০টি অবিশ্বাস্য তথ্য

শেষ কথা

রোবটিক চোখ এখন আর সাই-ফাই সিনেমার কল্পনা নয়। এটি বাস্তব, কার্যকর এবং মানুষের চোখের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার সামর্থ্য রাখে। জর্জিয়া টেকের এই গবেষণা ভবিষ্যতে রোবটিক্স জগতে বড় পরিবর্তন আনবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। চিকিৎসা, উদ্ধার, গবেষণা, এমনকি আমাদের দৈনন্দিন স্মার্ট ডিভাইসেও এই প্রযুক্তির ব্যবহার দেখা যেতে পারে। বাংলাদেশেও এই ধরনের উন্নত প্রযুক্তির সম্ভাবনা রয়েছে, যদি আমরা গবেষণা-উদ্ভাবনকে গুরুত্ব দিতে পারি।

📌 পোস্টটি শেয়ার করুন! 🔥

সর্বশেষ প্রযুক্তি বিষয়ক তথ্য সরাসরি আপনার ইমেইলে পেতে ফ্রি সাবস্ক্রাইব করুন!

Join 8,372 other subscribers

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *