আইফোনের পরিণতিও কি একদিন ব্ল্যাকবেরির মত হবে?

মেডিক্যাল গবেষকরা ইঁদুর নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে ভালোবাসেন কেননা এদের জীবনকাল খুব সংক্ষিপ্ত। এই অল্প সময়েই চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা পুরো একটি জীবনচক্রের ধারণা নিতে পারেন, যা মানুষসহ আরও অনেক প্রাণীর ক্ষেত্রে সম্ভব হয়না। বিশ্বব্যাপী ব্যবয়ায়িক ক্ষেত্রেও এরকম অসংখ্য “ইঁদুর” রয়েছে।

না, আমি বাস্তব ইঁদুরের কথা বলছিনা। মূলত মোবাইল ডিভাইস নির্মাতা কোম্পানিগুলোকেই এখানে “ইঁদুর” হিসেবে রূপায়িত করা হয়েছে, যেগুলো একের পর এক স্বল্প আয়ু নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হচ্ছে।

এই যেমন ব্ল্যাকবেরির কথাই ধরুন। কয়েক বছর আগেও রিসার্স ইন মোশন নির্মিত এই “মোবাইল সল্যুশন” এর বেশ কদর ছিল। বাংলাদেশী অপারেটর গ্রামীণফোনও ব্ল্যাকবেরি নিয়ে কত রংবেরঙের বিজ্ঞাপন দিত। বড় বড় বিবিওএস চালিত কোয়ের্টি হ্যান্ডসেট সারা বিশ্বেই এক ধরণের নিরাপত্তার প্রতীক হয়ে উঠেছিল।

কিন্তু এখন? ব্ল্যাকবেরির সেই সুদিন আর নেই। নিকট অতীতেই এর ম্যানুফ্যাকচারার কোম্পানিটি দেউলিয়া হওয়ার পথে বসেছিল। আর একের পর এক হতাশাজনক প্রান্তিকের খবর তো চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছেন।

আপনি যদি আন্তর্জাতিক মোবাইল শিল্পের গত দুই দশক খেয়াল করেন, তাহলে এরকম একাধিক উত্থানপতন দেখতে পাবেন।

১৯৮৩-৮৪ সালের দিকে মটোরোলা বিশ্বের সর্বপ্রথম মোবাইল ফোন উদ্ভাবন করেছিল। ডায়নাট্যাক (DynaTAC) ব্র্যান্ডনামের এই সেটগুলোর আরও পরিবর্তন-পরিবর্ধন সাধন করে মটোরোলাই এক সময় সেলুলার নেতৃত্ব দখল করে নিল।

এরপর একসময় ডিজিটাল যুগ এলো। কিন্তু মটোরোলা তাদের এনালগ প্রযুক্তি ছেড়ে দিতে অলসতার পরিচয় দিয়েছিল। নকিয়া এবং এরিকসন সেই সুযোগ গ্রহণ করল। দেখতে দেখতে সারা বিশ্বের মোবাইল বাজার দখল করে নিল ফিনিশ নকিয়া। এরিকসনও চেষ্টায় কম করেনি। কিন্তু এরা আরও কম জীবনীশক্তি বিশিষ্ট “ইঁদুরের” পরিচয় দেয়।

সিম্বিয়ান স্মার্টফোনের পাশাপাশি ব্ল্যাকবেরি বাজার দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু একসময় এন্ড্রয়েড এলো, সিম্বিয়ান নিয়ে নকিয়া আর এগোতে পারলনা। আরও কিছু প্রচেষ্টা বিফল হল। অ্যাপল আইফোন গ্রাহকদের মাঝে জনপ্রিয়তা লাভ করল। কিন্তু ব্ল্যাকবেরি তখনও আইফোনকে পাত্তা দিতে চাইতো না। রিমের কর্মকর্তারা একে একটি খেলনা হিসেবেই দেখতেন। প্রথম আইফোনটি বাজারে আসার মাত্র ৬ বছরের মধ্যে আজ ব্ল্যাকবেরি প্রায় বিলুপ্তির পথে বলা যায়।

অবশ্য আইফোনও যে খুব আহামরি অবস্থানে রয়েছে তাও কিন্তু নয়। এরও জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে শুরু করেছে। রিসার্স ফার্ম আইডিসির মতে, স্যামসাংয়ের বৈশ্বিক মোবাইল মার্কেট শেয়ার এখন ৩০.৪ শতাংশ। অপরদিকে অ্যাপলের মাত্র ১৩.১ শতাংশ। অথচ তিন বছর আগে প্রতি একটি গ্যালাক্সি স্মার্টফোনের বিপরীতে চারটি আইফোন বিক্রি হত। সেখানে এখন অ্যাপলের চেয়ে দ্বিগুণ বেশি স্মার্টফোন শিপ করছে স্যামসাং।

মোবাইল ইন্ডাস্ট্রিতে মটোরোলার অনেকগুলো পেটেন্ট রয়েছে। কিন্তু তারা এনালগ থেকে ডিজিটালে যাওয়ার ব্যাপারে উদাসীন ছিল। মটোরোলা যখনই ফোনকে আরও ছোট করার চেষ্টা করছিল, তখন অ্যাপল আরও স্মার্ট হ্যান্ডসেট তৈরির দিকে মনযোগী ছিল। ব্ল্যাকবেরি যখন তাদের ইমেইল ইন্টারফেস ও কর্পোরেট কাস্টমার নিয়ে আত্নতৃপ্তিতে মগ্ন ছিল অ্যাপল তখন সৃজনশীলতা ও ব্র্যান্ডের মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছিল। ব্ল্যাকবেরির ইঞ্জিনিয়ার টিম দক্ষ ছিল। কিন্তু অ্যাপলের ডিজাইনার টিম আরও কুশলীর পরিচয় দিয়েছে। নকিয়া যতটা সময় স্মার্টফোন অপারেটিং সিস্টেম সঙ্ক্রান্ত সিদ্ধান্ত নিতে ব্যয় করেছে, স্যামসাং ততদিনে এন্ড্রয়েডে ভর করে অনেক সামনে চলে গিয়েছে।

আর এখন, স্যামসাংয়ের সামনে অ্যাপলের ডিজাইনার/ডেভলপার টিমও মার খেয়ে যাচ্ছে। স্টিভ জবসের সেই বিখ্যাত উক্তিটি মনে পড়ে? “এটি (প্রযুক্তি বিশ্ব) এমন একটি জায়গা যেখানে কেউ এমন কোন নীতি রচনা করেনা যা ২০০ বছর ধরে প্রচলিত থাকবে। এটি এমন কোন ক্ষেত্র নয় যেখানে কেউ কোন ছবি আঁকবে এবং শতাব্দী ধরে মানুষ সেটি দেখতে থাকবে, অথবা এমন কোন গীর্জাও কেউ নির্মান করবেনা যা শত শত বছর ধরে মানুষের প্রশংসা পাবে এবং সবাই এটিকে অবাক হয়ে দেখতে থাকবে। না…… এটি এমন এক স্থান যেখানে প্রত্যেকে নিজের কাজটুকু করে ও বছর দশেকের মধ্যে তা হারিয়ে যায় এবং সত্যি সত্যিই ১০ বা ২০ বছর পর সেগুলোকে আর ব্যবহার করা যায় না”; অবশ্য, মোবাইল শিল্পে ১০ বছর প্রয়োজনও হয়না। এর আগেই অনেক কিছু ঘটতে পারে।

সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে সৃষ্টিশীলতা ও উদ্ভাবনধর্মী ক্ষমতা না থাকলে শুধু ব্র্যান্ড দিয়ে বেশিদূর যাওয়া যায়না। ল্যাবের ইঁদুরের মত পরীক্ষণ শেষে মার্কেটের বাইরে চলে যেতে হয়। তাহলে অ্যাপল- স্যামসাংয়ের পরে কার পালা?

📌 পোস্টটি শেয়ার করুন! 🔥

সর্বশেষ প্রযুক্তি বিষয়ক তথ্য সরাসরি আপনার ইমেইলে পেতে ফ্রি সাবস্ক্রাইব করুন!

Join 8,573 other subscribers

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *