এক চার্জে ৫৭০০ বছর চলবে এই ব্যাটারি

বর্তমান যুগে ব্যাটারির উপর নির্ভরতা দিন দিন বাড়ছে। স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ইলেকট্রিক গাড়ি থেকে শুরু করে মহাকাশ যান পর্যন্ত—সবকিছুতেই শক্তির একটি দীর্ঘস্থায়ী ও নির্ভরযোগ্য উৎস প্রয়োজন। কিন্তু আপনি কি কখনো কল্পনা করেছেন এমন একটি ব্যাটারির কথা, যেটি ৫৭০০ বছর ধরে চার্জ না দিয়েই চলতে পারবে? শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও, বিজ্ঞানীরা এখন সেই প্রযুক্তিই তৈরি করে ফেলেছেন। ব্রিস্টলের University of Bristol ও UK Atomic Energy Authority (UKAEA) মিলে উদ্ভাবন করেছে একটি কার্বন‑১৪ ডায়মন্ড ব্যাটারি, যা দীর্ঘস্থায়ী শক্তি সরবরাহের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। একবার প্রস্তুত করার পর একে আর চার্জ দিতে হবেনা। বরং এটি পারমাণবিক প্রক্রিয়ায় শক্তি সরবরাহ করে যাবে, যতদিন টিকে থাকবে ততদিন।

কার্বন‑১৪ ডায়মন্ড ব্যাটারির মূল ধারণা

এই ব্যাটারির প্রযুক্তিগত নাম হলো Betavoltaic Diamond Battery। এটি একটি বিশেষ ধরনের ব্যাটারি যেখানে শক্তির উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয় রেডিওঅ্যাকটিভ আইসোটোপ কার্বন-১৪ (Carbon-14)। এই আইসোটোপ পারমাণবিক বিকিরণের মাধ্যমে ধীরে ধীরে শক্তি নিঃসরণ করে, এবং সেই শক্তিকে ধরা হয় কৃত্রিম হীরা (lab-grown diamond) এর মাধ্যমে।

কার্বন‑১৪ এর অর্ধায়ু (Half-life) প্রায় ৫,৭৩০ বছর, যার মানে এই উপাদানটি প্রায় ছয় হাজার বছর ধরে ধীরে ধীরে শক্তি প্রদান করতে পারে। এই ব্যাটারির ভিতরে একটি ক্ষুদ্র ডায়মন্ড স্ট্রাকচার থাকে, যেটি এই বিকিরিত শক্তিকে বিদ্যুতে রূপান্তর করে।

কীভাবে কাজ করে ব্যাটারিটি?

এই ব্যাটারির মূল কাজের পদ্ধতি তুলনামূলকভাবে সহজ কিন্তু অত্যন্ত কার্যকর। এটি মূলত একটি বেটাভোলটাইক সেল (Betavoltaic Cell) — যেটি সূর্যরশ্মির পরিবর্তে ব্যবহার করে রেডিওঅ্যাকটিভ বিটা কণা।

  • কার্বন-১৪ উৎপাদন: পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের গ্রাফাইট ব্লক থেকে এই আইসোটোপ সংগ্রহ করা হয়।
  • ডায়মন্ড আবরণ: এরপর একটি কৃত্রিম হীরা আবরণ দিয়ে সেটিকে ঘিরে দেওয়া হয়, যা একদিকে রেডিয়েশন আটকায়, অন্যদিকে ইলেকট্রিক চার্জ সংগ্রহ করে।
  • বিটা বিকিরণ: কার্বন‑১৪ বিটা কণা (β-particles) নির্গত করে। এই কণাগুলি ডায়মন্ড উপাদানে আঘাত করে ইলেকট্রন উৎপন্ন করে।
  • বিদ্যুৎ উৎপাদন: এই ইলেকট্রন প্রবাহ থেকে তৈরি হয় বিদ্যুৎ, যা ব্যাটারির আউটপুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

এটি এক ধরনের সোলার সেলের মতো কাজ করে, কিন্তু সূর্যের আলো নয়, বরং পারমাণবিক বিকিরণ ব্যবহার করে শক্তি তৈরি করে।

battery
ব্যাটারি – প্রতীকী ছবি

🔥🔥 গুগল নিউজে বাংলাটেক সাইট ফলো করতে এখানে ক্লিক করুন তারপর ফলো করুন 🔥🔥

কেন এত দীর্ঘস্থায়ী?

কার্বন‑১৪ ব্যাটারির দীর্ঘস্থায়িত্বের রহস্য লুকিয়ে আছে এর রেডিওঅ্যাকটিভ সোর্স ও সেমিকন্ডাক্টর স্ট্রাকচারের মধ্যে। যেহেতু কার্বন-১৪ ধীরে ধীরে বিকিরণ ছাড়ে এবং তার অর্ধায়ু প্রায় ছয় হাজার বছর, তাই এই ব্যাটারি সহস্রাব্দব্যাপী শক্তি প্রদান করতে পারে

তবে এর মানে এই নয় যে ব্যাটারিটি ৫,৭০০ বছর পর হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাবে। বরং সময়ের সাথে শক্তি কমে আসবে, এবং ব্যবহার নির্ভর করবে অ্যাপ্লিকেশনের ধরন ও শক্তির প্রয়োজন অনুযায়ী।

কোথায় ব্যবহার হতে পারে এই ব্যাটারি?

এই ব্যাটারির উৎপাদিত শক্তির পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম — সাধারণ ব্যাটারির চেয়ে অনেক ধীরগতির। কিন্তু যেখানে দীর্ঘস্থায়ী, রিচার্জ-নির্ভরশীল নয় এমন শক্তি প্রয়োজন, সেখানেই এই ব্যাটারি বিপ্লব ঘটাতে পারে।

মহাকাশ গবেষণা

যেসব স্পেসক্র্যাফট বা স্যাটেলাইট হাজার হাজার বছর ধরে মহাকাশে ঘুরে বেড়ায়, তাদের জন্য এই ব্যাটারি একটি আদর্শ সমাধান। কারণ সেখানে রিচার্জের কোনো সুযোগ থাকে না।

👉 স্পেস স্যুট সম্পর্কে চমকপ্রদ কিছু তথ্য যা আপনার জানা ছিল না

মেডিকেল ইমপ্লান্ট

যেমন পেসমেকার বা কোক্লিয়ার ইমপ্লান্ট — যেগুলো শরীরের ভেতরে থাকে, এবং বারবার ব্যাটারি পরিবর্তন করা সম্ভব হয় না।

সেন্সর ও সামরিক ডিভাইস

দীর্ঘমেয়াদী সেন্সর বা গুপ্ত ডিভাইসে এই ব্যাটারি নিঃসন্দেহে কার্যকর।

রেডিও-ফ্রিকোয়েন্সি ট্যাগ ও IoT ডিভাইস

যেসব ডিভাইস কম বিদ্যুৎ ব্যবহার করে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করে, সেসব ক্ষেত্রেও এটি কার্যকরী।

পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ?

অনেকেই প্রশ্ন করেন — এটি তো রেডিওঅ্যাকটিভ বা তেজস্ক্রিয়, তাহলে এটি কি বিপজ্জনক? না, এই ব্যাটারি বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যাতে বিকিরণ বাহিরে ছড়াতে না পারে। ডায়মন্ড শেল বিটা বিকিরণ আটকাতে সক্ষম এবং এটি পরমাণু বর্জ্যকে পুনরায় ব্যবহার করে, ফলে পরিবেশবান্ধবও।

অর্থাৎ এটি পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার একটি উদাহরণ হিসেবেও কাজ করছে।

👉 আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন সম্পর্কে চমকপ্রদ কিছু তথ্য

সীমাবদ্ধতাও আছে

যদিও এই প্রযুক্তি ভবিষ্যতের জন্য আশাব্যঞ্জক, তবুও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে:

  • বিদ্যুৎ উৎপাদনের হার খুব কম, তাই বেশি শক্তি দরকার এমন যন্ত্রে ব্যবহারযোগ্য নয়।
  • উৎপাদন খরচ এখনো অনেক বেশি।
  • কার্বন-১৪ সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াকরণ এখনো কঠিন ও নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে হয়।
  • “রেডিওঅ্যাকটিভ” বা “তেজস্ক্রিয়তা” শব্দটির প্রতি মানুষের মানসিক প্রতিক্রিয়া নেতিবাচক ও ভীতিকর।

কার্বন‑১৪ ডায়মন্ড ব্যাটারি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এক অসাধারণ সাফল্য। এটি শুধু দীর্ঘস্থায়ী ব্যাটারির ধারণাকে বাস্তবে রূপ দিচ্ছে না, বরং পারমাণবিক বর্জ্য পুনঃব্যবহার এবং দূরবর্তী শক্তির অ্যাপ্লিকেশনেও বিপ্লব আনছে

এই ব্যাটারি হয়তো আগামী দশকে আমাদের স্পেস প্রোগ্রাম, স্বাস্থ্য প্রযুক্তি, এবং স্মার্ট সেন্সর সিস্টেমে বড় ভূমিকা রাখবে। তবে এর পূর্ণ বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু হতে এখনো কিছু সময় লাগবে।

📌 পোস্টটি শেয়ার করুন! 🔥

সর্বশেষ প্রযুক্তি বিষয়ক তথ্য সরাসরি আপনার ইমেইলে পেতে ফ্রি সাবস্ক্রাইব করুন!

Join 8,514 other subscribers

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *